পিতৃচরণে প্রণাম
আঙ্গুরবালা, কয়েকদিন আগে ‘বাবা দিবস’ চলে গেল। তখন আমি দৌড়োচ্ছি খুব সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি। বাবার কথা মনে পড়ছিলো, মনে পড়ছিলো তার ‘মাটিতে বুক ছুঁয়ে যাওয়া’ সংগ্রামের কথা। একজন স্কুল মাস্টারের আজীবন কষ্টের কথা, তাঁর ছোট ছোট গর্বের কথা, আর জীবনভর বয়ে চলা নৈতিক অবস্থানের কথা।
বাবাকে নিয়ে লিখিনি কোনোদিন। কী-ই-বা লিখবো। যখন তোমার মনে পড়বে ‘বাবা’ শব্দটা, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যেতে পারে বাবাও একজন ‘পুরুষ’। পুরুষের যাবতীয় নৃশংসতা আর আধিপত্যসুলভ মানসিকতা নিয়েই তিনিও জীবনযাপন করেছেন, নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন নিজস্ব নারীকে। যেহেতু আমাদের ‘বাবা’রা এই সমতার সময়ে জন্ম নেননি তাই কাজটি করেছেন একেবারেই অজান্তিতে, এইটুকুই স্বস্তির। সকল বাবা এই আধিপত্য বজায় রেখেছেন মায়েদের উপর সেটি সত্য নাও হতে পারে। কিন্তু এই-ই স্বাভাবিক প্রবণতা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজ স্বাতন্ত্র্য আর স্বাধীনতা বজায় রেখেই পুরুষের উচিৎ আরও কয়েক শ’ বছর নারীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া, যেমন বলেছেন কবীর সুমন :
কিন্তু ‘পুরুষ’-এর বাইরেও বাবার একটা ভূমিকা আছে। সন্তানের কাছে তিনি শেষ আশ্রয়, সকল ঝড়-ঝাপটার মুখে এক অবিচল দেয়ালের মতো। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কতোবার যে বলেছি “বাবা হলেন ছাতা”। তুমুল বৃষ্টির দিনে পথ চলতে চলতে বাতাসের গতি আর দিকের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ছাটও পরিবর্তন করে তার গতিমুখ। তখন ছাতাটা তুমি সেদিকেই ধরো ঘুরিয়ে। সামান্য বৃষ্টি গায়ে আসে লাগে বটে, কিন্তু মূখ্যত সবদিক দিয়েই সে রক্ষা করে তোমার শরীর। আচ্ছা, তুমি কি ‘শরীর’ মানে জানো? শরীর কথাটা এসেছে ‘শৃ’ ধাতু থেকে। তার মানে হলো ‘যা কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়’। এ কারণেই আমরা কাউকে কুশল জিজ্ঞাসা করার সময় বলি ‘শরীর কেমন?’ অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু জিনিসটার খবর কী। অন্যদিকে যখন নর্তকীর কথা ওঠে তখন বলি “নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান” (রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)। ‘দেহ’ শব্দটা এসেছে ‘দিহ’ ধাতু থেকে যার অর্থ ‘যা কিছু বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়’।
প্রতিদিন আমরা এমন সব শব্দ ব্যবহার করি না বুঝেই। এগুলো আমাদের বংশসারের মধ্যে রয়ে গেছে। ভাষার ভেতরের এই মজাটা আমার খুব পছন্দ। তোমারও হয়তো। একটা উদাহরণ দেই : নটেগাছ মানে তুমি কী বোঝো? নটে শাক তো? Amaranthus viridis! কিন্তু বাংলা ভাষা তো ‘প্রতীকভিত্তিক ভাষা’ না, এটা ‘ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা’। তাই বাংলায় যখন ‘নটে’ কথাটা ভাববে তখন শব্দটাকে ভাঙতে হবে। ক্রমশ যেতে হবে গভীরে যেখানে ‘বর্ণ’ বা ‘হরফ’ মিলে ‘ধাতু’ তৈরি করে। ধাতুর সঙ্গে নতুন ‘ধ্বনি’ যোগ হয়ে ‘শব্দ’ তৈরি হয়। এর প্রত্যেক পর্যায়ের আলাদা আলাদা অর্থ আছে আর এগুলো মিলে অর্থ নিষিক্ত হয়।
নটে : ১. নটকরণ (অভিনয়) করার জন্য যে প্রস্তুত (নটে, অভিনেতা); ২. নটকরণ (সাময়িক সাজসজ্জা, সাময়িক চরিত্রগ্রহণ) ব্যবস্থা আছে যাতে (নটেদল); ৩. নটকরণ শেষে যে দল (গাছ) ভেঙে যায় (নটে গাছ মুড়ানো); ৪. সাময়িকভাবে যে গাছ গজিয়ে ওঠে (নটে শাক)। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো ‘নটে গাছ’ মানে শুধু একটা শাক বা Amaranthus viridis না বরং নাট্যাভিনয় ও নাট্যদলও বুঝায়। এ কারণেই বয়োবৃদ্ধ প্রপিতামহী/মাতামহীরা ‘নটে গাছটি মুড়ালো’ বলতে বোঝান যে নাট্যদলটা ভেঙে গেছে, সুতরাং গল্পও ফুরিয়েছে। বাংলা ভাষাটার এই শক্তিটা ভয়ঙ্কর।
তেমনি পিতা এসেছে ‘পা’ ধাতু থেকে, অর্থাৎ ১. পালন করেন যিনি; ২. যাহার হইতে নিপতিত। এ কারণেই বাংলায় পিতা পাঁচজন : জন্মদাতা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, জ্ঞানদাতা ও কন্যাদাতা। কিন্তু প্রতীকভিত্তিক ভাষা, যথা ইংরেজি, অনুসরণের কারণে ধীরে ধীরে আমরা পিতা বলতে শুধুমাত্র জন্মদাতাকেই বুঝছি। শাহ মুহম্মদ সগীরের কথাও ভুলে গেছি। তিনি অন্তত দ্বিতীয় পিতার বলেছিলেন : “ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়। দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।।” তোমার মনে আছে এই মধ্যযুগীয় কবির কথা?
তোমার পিতা কেমন ছিলেন, আমি জানি না। সাধারণত কন্যাসকল পিতার ন্যাওটা হয়। তুমিও খুব ছোটবেলায় তাই ছিলে নিশ্চয়ই? তোমার মনে আছে সেসব কথা? কেমন ছিলেন দেখতে তিনি? কেমন করে হাসতেন? নাকি থাকতেন সদাই গম্ভীর হয়ে। আর তোমাদের শেখাতেন, “রামগরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা...”। কন্যাদের প্রতি পিতা বরাবরই বেশিমাত্রায় সদয় আর আন্তরিক হন। তোমার পিতাও কি তাই ছিলেন?
আমি জানি না। জানতে চাই জীবনের এইসব ছোট্ট ছোট্ট সুখগুলো যা ভাগাভাগি করলে মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে পড়ে হৃদয় থেকে হৃদয়ে।