ভবঘুরের পর্যটন
আমি সারাজীবনই ভীষণ রকম বেহিসেবি, সেটা তো তুমি জানো আঙ্গুরবালা। তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। অবস্থান পাইকগাছা উপজেলার বাঁকা বাজারে। আশাশুনির একদম সীমানায়। দুই গ্রামের মাঝখানে মরা কপোতাক্ষ নদ। তাতে অল্প একটু পানি। সেই পানিতে নৌকার কোলে চড়ে বাজারের পেছনদিকটায় শুয়ে থাকে সুন্দরী, পশুর, গর্জন আর ধুন্দলের গুড়ি। আমি সন্ধ্যেটায় সেতুর ’পরে বসে বৃক্ষের লাশ দেখি আর অপ্রকাশযোগ্য রাগে ফুলি। কখনও নৌকার ডালিতে ঝুলে গাছের সমাধিযাত্রা দেখতে দেখতে চোয়ালভাঙা মাঝির চেহারা দেখি। এভাবে মাস শেষ হলে সোজা দৌড়ে চলে আসি মায়ের কাছে। তার হাতে তুলে দেই মাসের টাকাটা। মা আবার আমার জন্য বরাদ্দ করেন, চাহিদা ও মর্জিমতো। ক’ টাকা বেতন পাই? সে শুনলে তুমি কেঁপে উঠবে। এই শৈত্যপ্রবাহের সময়ে বাড়তি কাঁপাকাঁপি থামাবার লোক তো পাওয়া যাবে না! তুমি বরং জমে ওঠা বরফের মতোই স্থির থাকো, যতোক্ষণ না বসন্ত-বাতাস বইছে লেকের ধারটায়।
এমনি এক ঈদের ঠিক আগেরদিন দুপুরবেলা এসে পৌঁছেছি বাড়িতে। মা গুণে গুণে আমাকে টাকা দিলেন ঈদের পাঞ্জাবি কেনার জন্য। তখনকার দাম অনুসারে সেটা খুশি হবার মতো টাকা। আমিও গেলাম বাজারে। যেতে যেতেই মাথায় এলো, ঈদের পর তো আবার ও ধ্যাদ্দেড়ে বাঁকা বাজারেই যেতে হবে। তারপর রাত কাটবে কী করে? পড়ার মতো আর তো কোনো বই নেই। পাঞ্জাবি কেনার আগে একখানা যুৎমতো বই কিনে ফেললে হয়। অন্তত সপ্তাখানেক তো পড়তে হবে! সোজা হাজির হলাম ‘বইঘর’-এ, পরিচিতি আর স্বাদের জানাশোনা আছে - তাই। গিয়ে এটা দেখি, ওটা দেখি; আর পছন্দও হয়। পছন্দের পাল্লায় পড়ে কিনে ফেললাম অনেকগুলো বই। তারপর পাঞ্জাবি, হাত খরচ, ঈদের সেলামি - সব শেষ করে কয়েকখানা বই নিয়ে ফিরলাম বাড়িতে। ঈদটা বড়ো বাজে গিয়েছিলো সেবার!
এই দ্যাখো, কথায় কথা আসে। আর একবার ঢাকায় গিয়েছি ‘কৃষি সিম্পোজিয়াম’-এ অংশ নিতে। সঙ্গে নিয়েছি Sawrav দা কিছু টাকা পেতেন, সেটা। তখন ফেব্রুয়ারির বইমেলা চলছে। সিম্পোজিয়াম শেষে আমি আর Masud ভাই বেরিয়েছি একটু বইমেলা ঘুরে দেখবো বলে। ফিরবার সময় দু’জনে আর বয়ে আনতে পারি না। হোটেলে ফিরে Nandy দা’র একটা ব্যাগ দু’জনে নেয়ার জন্য কী যে কাড়াকাড়ি! কারণ আমাদের বই বয়ে নেয়ার মতো কোনো ব্যাগই নেই। শেষে Masud ভাই-ই পেয়ে গেলেন ব্যাগটা। উনিই আগে চেয়েছিলেন যে! কিন্তু বাড়ি ফেরার টাকা? আমি তো Nandy দা’র ঘাড়ে চড়ে বসেছি। মাসুদ ভাই কোত্থেকে কী করেছিলেন, আজ আর জানি না। আর Sawrav দা? ওই দুঃখে চলে গেলেন দূরদেশ কানাডায়!
বলছিলাম বেহিসেবি জীবনের কথা। এরই মধ্যে সাধ হয়, ইচ্ছে হয়, স্বপ্ন দেখি। কয়েক বছর আগে স্বপ্ন দেখছিলাম একটা ভদ্রগোছের সুন্দর পর্যটনের প্রতিষ্ঠান যদি বানানো যেতো! পৃথিবীর নানা দেশে কী সুন্দর পরিপাটি ব্যবস্থা! তেমনটা যদি আমাদের দেশে হতো, তবে কত্তো না ভালো হতো। কিন্তু এখানে টাকা খরচ হয়, পরিসেবা নিশ্চিত হয় না। ওইটুকু পরিসেবা, জানতে সুযোগ দেয়া আর পর্যটককে তাঁর মতো থাকতে দেয়া - এই তিনটে জিনিস নিশ্চিত করতে পারলে শুধু সুন্দরবন আর কক্সবাজার বেচেই দেশ চলতে পারতো। যেখানেই যাই, পরিসেবার স্টাইলটা নোট করে নিয়ে আসি। শুধু একটা ইচ্ছে : নিসর্গ দেখা আর জানার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ দেয় এমন একটা পর্যটন গড়ে তুলতে সাহায্য করা।
এইসব ভাবনার মধ্যে আরো অনেকেই ছিলেন। Mukta ভাই, Lablu ভাই, হানিফা ভাই, Aaman ভাই - সবারই নানান পর্যায়ে ছিলো অংশগ্রহণ আর পরামর্শ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আমিই নেমে পড়লাম এক আয়োজনে। নাম দিয়েছিলাম ‘বনবিবির ডেরায়’, সেটাও তুমি জানো। বন্ধুরা অনেকেই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানান ঝক্কিতে শেষ পর্যন্ত গুঁড়োগাড়াসহ সাকুল্যে ২৪-২৫ জন যেতে পেরেছিলাম। নিজেকেও যাত্রীর মধ্যে ধরছি কারণ উদ্যোক্তা হিশেবে আর মানাচ্ছিলো না শেষ পর্যন্ত। ভ্রমণটা সত্যিই দারুণ ছিলো। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তা ছিলো ভয়াবহ।
আগেও এমন হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক হিসাব-নিকাশ - এসব ক্ষেত্রে আমি একদম ন্যাক্কারজনক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো রোমহর্ষক। দেখা গেল, এক অনুষ্ঠানের পুরো টাকা আগেই খরচ করে ফেলেছি বাজেট বিবেচনায় না নিয়েই। পরে অনেক ধার দেনা করে অনুষ্ঠান তুলতে হয়েছে। তাই অনেকবারই কান ধরেছি, ও পথ আর মাড়াবো না। কিন্তু আবারও মাড়িয়েছি। ওই যে, বেহিসেবি’র প্রমাণ দিতে হবে না!
শেষ পর্যন্ত একটা হিল্লে হয়েছে। সহোদর Kamruzzaman শুরু করেছে একটা পর্যটন প্রতিষ্ঠানের কাজ। তুমি তো জানো, ওর ব্যবসায়িক বুদ্ধি খুব সুন্দর। সাজানো এবং পরিকল্পিত। তাই আমি ওর সাথে যুক্ত হয়েছি ‘অকর্মী’ সহায়ক হিশেবে। এমনিতেও যুক্ত হতাম দুটো কারণে : এক. সুন্দরবন, আর দুই. ঘোরাঘুরির সুযোগ। আরো অনেকেই যুক্ত হবেন নিশ্চয়ই। পর্যটন এদেশে লাভজনক আর মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। পর্যটন পুলিশ হয়েছে, নিরাপত্তারও উন্নতি হয়েছে। আর কয়েকটা পরিসেবা কয়েক বছরের মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে যাবে, জানি। আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটতে তো একটু সময় লাগেই।
প্রতিষ্ঠানটার নাম দিয়েছে ‘ব্যাকপ্যাকার্স’ (Backpackers), মানে যারা পিঠে একটা ব্যাগ নিয়েই ঘুরতে শুরু করতে পারে এমন সাহসী লোকজনের জন্য প্রতিষ্ঠান। গত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই এ বছর ও সাজিয়েছে সুন্দরবন-যাত্রার এক উদ্যোগ। নামটাও একই রেখেছে ‘বনবিবির ডেরায়’। আজকেই যাত্রা শুরু করলো ছোট ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান। আমার আইডিয়া, ওর প্রচেষ্টার সাথে তোমার শুভকামনা তো ও পাবে নিশ্চয়ই।
তুমি কি যাবে ওর আয়োজনে?
এমনি এক ঈদের ঠিক আগেরদিন দুপুরবেলা এসে পৌঁছেছি বাড়িতে। মা গুণে গুণে আমাকে টাকা দিলেন ঈদের পাঞ্জাবি কেনার জন্য। তখনকার দাম অনুসারে সেটা খুশি হবার মতো টাকা। আমিও গেলাম বাজারে। যেতে যেতেই মাথায় এলো, ঈদের পর তো আবার ও ধ্যাদ্দেড়ে বাঁকা বাজারেই যেতে হবে। তারপর রাত কাটবে কী করে? পড়ার মতো আর তো কোনো বই নেই। পাঞ্জাবি কেনার আগে একখানা যুৎমতো বই কিনে ফেললে হয়। অন্তত সপ্তাখানেক তো পড়তে হবে! সোজা হাজির হলাম ‘বইঘর’-এ, পরিচিতি আর স্বাদের জানাশোনা আছে - তাই। গিয়ে এটা দেখি, ওটা দেখি; আর পছন্দও হয়। পছন্দের পাল্লায় পড়ে কিনে ফেললাম অনেকগুলো বই। তারপর পাঞ্জাবি, হাত খরচ, ঈদের সেলামি - সব শেষ করে কয়েকখানা বই নিয়ে ফিরলাম বাড়িতে। ঈদটা বড়ো বাজে গিয়েছিলো সেবার!
এই দ্যাখো, কথায় কথা আসে। আর একবার ঢাকায় গিয়েছি ‘কৃষি সিম্পোজিয়াম’-এ অংশ নিতে। সঙ্গে নিয়েছি Sawrav দা কিছু টাকা পেতেন, সেটা। তখন ফেব্রুয়ারির বইমেলা চলছে। সিম্পোজিয়াম শেষে আমি আর Masud ভাই বেরিয়েছি একটু বইমেলা ঘুরে দেখবো বলে। ফিরবার সময় দু’জনে আর বয়ে আনতে পারি না। হোটেলে ফিরে Nandy দা’র একটা ব্যাগ দু’জনে নেয়ার জন্য কী যে কাড়াকাড়ি! কারণ আমাদের বই বয়ে নেয়ার মতো কোনো ব্যাগই নেই। শেষে Masud ভাই-ই পেয়ে গেলেন ব্যাগটা। উনিই আগে চেয়েছিলেন যে! কিন্তু বাড়ি ফেরার টাকা? আমি তো Nandy দা’র ঘাড়ে চড়ে বসেছি। মাসুদ ভাই কোত্থেকে কী করেছিলেন, আজ আর জানি না। আর Sawrav দা? ওই দুঃখে চলে গেলেন দূরদেশ কানাডায়!
বলছিলাম বেহিসেবি জীবনের কথা। এরই মধ্যে সাধ হয়, ইচ্ছে হয়, স্বপ্ন দেখি। কয়েক বছর আগে স্বপ্ন দেখছিলাম একটা ভদ্রগোছের সুন্দর পর্যটনের প্রতিষ্ঠান যদি বানানো যেতো! পৃথিবীর নানা দেশে কী সুন্দর পরিপাটি ব্যবস্থা! তেমনটা যদি আমাদের দেশে হতো, তবে কত্তো না ভালো হতো। কিন্তু এখানে টাকা খরচ হয়, পরিসেবা নিশ্চিত হয় না। ওইটুকু পরিসেবা, জানতে সুযোগ দেয়া আর পর্যটককে তাঁর মতো থাকতে দেয়া - এই তিনটে জিনিস নিশ্চিত করতে পারলে শুধু সুন্দরবন আর কক্সবাজার বেচেই দেশ চলতে পারতো। যেখানেই যাই, পরিসেবার স্টাইলটা নোট করে নিয়ে আসি। শুধু একটা ইচ্ছে : নিসর্গ দেখা আর জানার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ দেয় এমন একটা পর্যটন গড়ে তুলতে সাহায্য করা।
এইসব ভাবনার মধ্যে আরো অনেকেই ছিলেন। Mukta ভাই, Lablu ভাই, হানিফা ভাই, Aaman ভাই - সবারই নানান পর্যায়ে ছিলো অংশগ্রহণ আর পরামর্শ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আমিই নেমে পড়লাম এক আয়োজনে। নাম দিয়েছিলাম ‘বনবিবির ডেরায়’, সেটাও তুমি জানো। বন্ধুরা অনেকেই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানান ঝক্কিতে শেষ পর্যন্ত গুঁড়োগাড়াসহ সাকুল্যে ২৪-২৫ জন যেতে পেরেছিলাম। নিজেকেও যাত্রীর মধ্যে ধরছি কারণ উদ্যোক্তা হিশেবে আর মানাচ্ছিলো না শেষ পর্যন্ত। ভ্রমণটা সত্যিই দারুণ ছিলো। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তা ছিলো ভয়াবহ।
আগেও এমন হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক হিসাব-নিকাশ - এসব ক্ষেত্রে আমি একদম ন্যাক্কারজনক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো রোমহর্ষক। দেখা গেল, এক অনুষ্ঠানের পুরো টাকা আগেই খরচ করে ফেলেছি বাজেট বিবেচনায় না নিয়েই। পরে অনেক ধার দেনা করে অনুষ্ঠান তুলতে হয়েছে। তাই অনেকবারই কান ধরেছি, ও পথ আর মাড়াবো না। কিন্তু আবারও মাড়িয়েছি। ওই যে, বেহিসেবি’র প্রমাণ দিতে হবে না!
শেষ পর্যন্ত একটা হিল্লে হয়েছে। সহোদর Kamruzzaman শুরু করেছে একটা পর্যটন প্রতিষ্ঠানের কাজ। তুমি তো জানো, ওর ব্যবসায়িক বুদ্ধি খুব সুন্দর। সাজানো এবং পরিকল্পিত। তাই আমি ওর সাথে যুক্ত হয়েছি ‘অকর্মী’ সহায়ক হিশেবে। এমনিতেও যুক্ত হতাম দুটো কারণে : এক. সুন্দরবন, আর দুই. ঘোরাঘুরির সুযোগ। আরো অনেকেই যুক্ত হবেন নিশ্চয়ই। পর্যটন এদেশে লাভজনক আর মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। পর্যটন পুলিশ হয়েছে, নিরাপত্তারও উন্নতি হয়েছে। আর কয়েকটা পরিসেবা কয়েক বছরের মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে যাবে, জানি। আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটতে তো একটু সময় লাগেই।
প্রতিষ্ঠানটার নাম দিয়েছে ‘ব্যাকপ্যাকার্স’ (Backpackers), মানে যারা পিঠে একটা ব্যাগ নিয়েই ঘুরতে শুরু করতে পারে এমন সাহসী লোকজনের জন্য প্রতিষ্ঠান। গত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই এ বছর ও সাজিয়েছে সুন্দরবন-যাত্রার এক উদ্যোগ। নামটাও একই রেখেছে ‘বনবিবির ডেরায়’। আজকেই যাত্রা শুরু করলো ছোট ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান। আমার আইডিয়া, ওর প্রচেষ্টার সাথে তোমার শুভকামনা তো ও পাবে নিশ্চয়ই।
তুমি কি যাবে ওর আয়োজনে?