কেয়াফুলের সংসার

Pandanus foetidus (কেয়াকাঁটা)
আঙ্গুরবালা, বর্ষারণ্যের পাঁড় পর্যটক ভদ্রলোক ও লোকিনীদের নিতান্ত অ্যাডভেঞ্চারের শখে না কামড়ালে সুন্দরবনে ভ্রমণে আসেন না। এ তো আর গাড়ি থেকে নেমে জুতো মচমচিয়ে হাঁটা আর সেলফোনে সেলফি তোলা নয়, রীতিমতো কসরৎ করতে হয়। তাই যাঁরা আসেন আর পুরো দিন লঞ্চের ছাদে বসে শুধু চলতেই দেখেন, তারা মনে মনে ভাবেন বোটের ছাদে নাচনা-গানা হবে, নদীর পাড়ে বোট ভিড়িয়ে বোটেই শুয়েবসে কাতচিৎ হয়ে আয়েশের সঙ্গে সুন্দরবন দেখবেন, তারপর বাড়ি গিয়ে গিন্নিকে বলেন, "বুঝলে গিন্নি, কেবল গাছ আর গাছ। গাছের জ্বালায় বন দেখতে পারিনি!" অপরপক্ষে আরেক দল আছেন। তাঁরা দশ কি বারোর একটা দঙ্গল হৈ হৈ করে বনে ঢুকবেন, বোর্ডওয়াক ধরে হাঁটবেন, ডাঙ্গুলি খেলবেন, বাঁদর দেখলে ঢিল ছুঁড়বেন, বাদাম-চিপসের ঠোঙা ফেলবেন এবং শেষে বোটে ফিরে এসে বলবেন, "কী বাজে ট্যুর অপারেটর, একটা বাঘও দেখাতে পারেনি!" তাই আমার বন্ধু মার্টিন বিরক্ত হয়ে বলতো, “বাবারা, শব্দদুষণের জন্য তো তোমাদের শহরটা আছে। এসব করার জন্য কষ্ট করে বনে এলে কেন?”

এই পর্যটকেরা হলেন আদি ও অকৃত্রিম 'ভ্রমণকারী'। 'ভ্রমণকারী' শব্দটার অর্থ জানো তো? ভ্রমণকারীর সোজা অর্থ 'যিনি ভ্রমণ করেন'। এবার একটু ভেবে দেখ, ‘ভ্রমণ’ শব্দটা এসেছে 'ভ্রম' থেকে। এবার একটু আঁচ করতে পেরেছো মনে হয়। ভ্রম শব্দটার মূল ধাতু ভ্রম্ যার অর্থ 'নির্দিষ্ট হতে না পারা' বা 'অস্পষ্ট ধারণা বা ঘোরাঘুরি করা'। এবার ভ্রম্-এর সঙ্গে 'অ(ঘঞ)' যোগ করলে হবে 'ভ্রম' যার অর্থ অনির্দিষ্টভাবে চলাফেরা করা। যদি মানুষ চলাফেরা করে তবে তা পর্যটন (কে তুমি একাকী ভ্রম নির্জন কাননে?), আবার যদি জল চলাফেরা করে তবে তা ঘূর্ণন (অবিরল জলভ্রমি)। এই অর্থে ভ্রম মানে আবার যা কিছু আবছা বা দূরবর্তী দেখা যায়। তুমি যদি কারো দূরের হও তার ক্ষেত্রে তোমার ‘স-ভ্রম’ বা সম্ভ্রম থাকবে। বহুজনের কাছে সম্ভ্রম অর্জিত হলে তখন তোমাকে বলা হবে 'সম্ভ্রান্ত'। এবার ভ্রম্-এর সাথে 'লি' যুক্ত করলেও 'ভ্রম' হবে। এই ভ্রম অর্থ 'ভুল', মানে তুমি অর্থ নির্দিষ্ট করতে পারোনি। আরো আরো অর্থ হয় ভ্রমের, তা বলতে গেলে আলাদা আরেক গল্প হয়ে যাবে। আপাতত এই বাচাল ক্ষান্ত দিলো!

বলছিলাম সৌখিন ভ্রমণিকেরা কেন বাদাবনে ঘুরতে চান না, তার কথা। বাদাবনের কাদার কথা তো জানো তুমি। যে বনভূমি দৈনিক দু'বার নোনাজলে স্নান করে পবিত্র হয়, তার উপর পা দিতে সাহস লাগে। বাদাবন নিজেকে আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্যই যেন হাঁটু অব্দি কাদা বিছিয়ে রেখেছে নিজ শরীরের উপর। আরো অনেক রক্ষাকবচ আছে তার। অধিকাংশ গাছের আছে শুলো বা শ্বাসমূল। একটু অসাবধান হলেই পায়ের তলায় খোঁচা খাবে, অথবা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আর অজগর, কেউটে বা বাঘের ভয়? সে তো তোমার খাঁচার ভেতরে হৃৎপিণ্ডটিকে দুমড়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এসব নজর দিতে দিতে ভুলে যাবে তোমার পাশেই কোমর-সমান উঁচু হয়ে আছে নাটা (Caesalpinia bonduc), কুটুমকাঁটা (Caesalpinia crista), হরগজা (Acanthus ilicifolius) বা হেঁতাল (Phoenix paludosa)। পূর্ণবয়স্ক হেঁতাল অবশ্য তোমার মাথা ছাড়িয়ে আরো বড়ো হয়, নাটাও তাই। তবে এদের সবার গায়েই ভয়ঙ্কর কাঁটা আছে। কোনোটা তোমায় কুটুম ভেবে টেনে ধরবে, কেউ ‘আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো কোথায়?' বলে তোমার পায়ে আঁচড় কেটে দিবে।

কেয়াও এরকম একটা আত্মরক্ষা-সচেতন গাছগুলোর একটা। সুন্দরবনের বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রের একটি হলো হারবাড়িয়া। নৌকো থেকে হারবাড়িয়া ঘাটে নামার সময়ই দেখবে আনারসের মতো কাঁটাঅলা লম্বা লম্বা পাতা বাড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছে কেয়াকাঁটা বা কাইকি কাঁটা (Pandanus foetidus)। সুন্দরবনের যেসব নদী বা খালের পাড়ে একটু স্থিতিশীল ভূমি পাওয়া যায় সেখানেই কেয়াকাঁটা আছে, যদিও হরগজা বা গোলপাতার (Nypa fruticans) আওলাদেরা দখল করে রাখে প্রায় সবটা জায়গা। কেয়াকাঁটার আরেক বোন আছেন সুন্দরবনে। তাঁর নাম কেয়া বা কেতকী (Pandanus tectorius)। এঁরা কিন্তু বাদাবনের আদি ও বনেদি অধিবাসী না। এদের ভাইবোনেরা ছড়িয়ে আছেন সারা পৃথিবীতে ভূমি-বায়ু-আলো নির্বিশেষে। তাই এঁরা মূখ্যবাদা (Major Mangrove) বা গৌণবাদার (Minor Mangrove) মর্যাদা পাননি। এই দু’বোন বাদাগাছের সাথে থাকতে পছন্দ করেন, তাই এঁরা বাদা সহচর (Mangrove Associate) খেতাব পেয়েছেন।

সাধারণত বাদাগাছের এক একটি গণ (Genus) ভাইবোনের সংখ্যা চার-পাঁচজন, সর্বোচ্চ ছ’জন। গোলপাতার মতো কেউ কেউ আছেন যাঁরা এমন উচ্চবংশীয় যে উনি একাই এক 'গণ'-এর প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু প্যান্ডানাসগণ কতো ভাইবোন তা শুনলে তুমি আঁতকে উঠবে। বলবো? এদের জেনাস বা সংসারের সদস্যসংখ্যা ৭৩৪ মাত্র (সাড়ে সাতশ’ও হতে পারে!)। ওই যে, এক লোক ব্যাংকের চেকে লিখেছিলো "এক কোটি টাকা মাত্র", তেমন! ভাইবোনের সংখ্যা গুণতে গুণতেই তোমার দিন শেষ। এঁদের গোত্রের (Family) নাম Pandanaceae। Pandanus নামটি এসেছে মালয় শব্দ Pandang থেকে। প্যান্ডাং কেয়ারই মালয় নাম। তাহলে আমি Pandanaceae-কে ‘কেতকী গোত্র’ বলি? তুমি কেয়াগোত্রও বলতে পারো। প্যান্ডানাস শব্দটা গ্রীক ভাষায় পুরুষবাচক হলেও, বাংলা ভাষায় কেয়া বা কেতকী স্ত্রীবাচক শব্দ। তাই প্যান্ডানাসদেরকে বাংলায় বোন বলাই বিধেয়। আমরা যেটাকে ‘কেওড়া জল’ বলি সেটা এই কেতকী বংশেরই একটি ফুলের নির্যাস। ফুলের নাকি ফলের নির্যাস, তা নিয়ে বেশ দ্বন্দ্ব আছে। সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। ঠিক আছে, সোনা?

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ অনুসারে বাংলাদেশে এদের সহোদরের সংখ্যা ছয়। এসো তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। এই ছয় ভাইবোনের মধ্যে দু’জনকে বলা হয় ‘কেয়াকাঁটা’ বা ‘কাইকি কাঁটা’ (Pandanus foetidusPandanus odorifer);  দুজন পরিচিত শুধু ‘কেয়া’ বা ‘কেতকী’ নামে (Pandanus furcatusPandanus tectorius); একজন পরিচিত ‘ছোটকেয়া’ নামে (Pandanus unguifer) এবং সর্বশেষ একজন নিজের পরিচয় দেন ‘পোলাওপাতা’ বা ‘ভোগের পাতা’ নামে (Pandanus amaryllifolius)। আগেই তো বলেছি, এর মধ্যে সুন্দরবনে দু'জন বসতি গেঁড়েছেন। দু’ভায়ের মধ্যে যাঁর নাম Pandanus foetidus বা কেয়াকাঁটা তার পরিমাণ সুন্দরবনে বেশি, যদিও অন্যান্য দেশের বাদাবনে Pandanus tectorius বা কেয়াই বেশি আছে। তবে একটা ধন্দের কথা আগেই বলে নেই, সাঈদুর রহমান (২০১৫) বলেছেন সুন্দরবনে Pandanus tectorius আছে। আবার বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ বলছে বাংলাদেশে P. tectorius নেই, কিন্তু Pandanus furcatus আছে। ও ধরনের বৃক্ষাকৃতির কেয়া আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি। তাই আমি দুটোই রেখে দিচ্ছি।
Pandanus foetidus (কেয়াকাঁটা)

এই যে পোলাওপাতা (Pandanus amaryllifolius), এটাই খাদ্য বিষয়ক সুগন্ধীর উৎস। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে নিশ্চয়ই দেখেছো, নারকেল পাতার মতো একটা পাতা দিয়ে জড়িয়ে রাখা ভাত খেতে দেয়। সম্মানিত অতিথিদের খুব আদর করে খেতে দেয় ওটা। ওই পাতাটা P. amaryllifolius-এর। অন্যান্য তরকারি রান্নার জন্য পাতা ফালি ফালি করে কাটা হয়। এরপর পাতা দিয়ে তরকারি বেঁধে ছেড়ে দেয়া হয় অন্যান্য মসলার ঝোলের মধ্যে। রান্না শেষে পাতাটা আবার খুলে নেয়া হয়। এছাড়া পোলাওপাতার সুগন্ধি ব্যবহার করা হয় কেক বা আইসক্রিম তৈরিতেও। ব্যাংককের হাটে-বাজারে গেলে দেখবে প্রৌঢ়ারা এরকম শুকনো পাতার ফালি বিক্রি করছে রাস্তার ধারে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের কোনো কোনো এলাকায় কমদামি বিরিয়ানি থেকেও বাসমতি চালের সুগন্ধ পাওয়া যায়। এর কারণ হলো বাসমতি চাল ও পোলাওপাতার সুগন্ধ একই। দুটোতেই একই রাসায়নিক উপাদান আছে। মাঝারি মানের রেস্তোঁরায় বিরিয়ানি রান্নার সময় বাসমতি চালের বদলে সাধারণ চালের মধ্যে পোলাওপাতা দিয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কার স্থানীয় রান্নাতেও পোলাওপাতার সুগন্ধী ব্যবহার করা হয়। শ্রীলঙ্কাতে পাতার নির্যাসও পাওয়া যায় বোতলে।

পোলাওপাতার ফুলের নির্যাস থেকেই তৈরি হয় কেওড়া জল কারণ কেয়া ফুলের হিন্দি প্রতিশব্দ কেওড়া (Kewra, Kevda, Kevada)। আমি এক সময়ে ভাবতাম সুন্দরবনের কেওড়া ফুল থেকে এই নির্যাস তৈরি হয়। কিন্তু কেওড়া ফুলের সুবাসের সঙ্গে কেওড়া জলের কোনো মিল না দেখে ভেবেছিলাম এটা বোধহয় সুন্দরবনের অজানা কোনো গাছের ফুল থেকে তৈরি হয়, আর কোলকাতার কোনো এক মহারথী এটার নাম দিয়েছেন কেওড়ার জল। কিন্তু কোনোদিন সেই নির্দিষ্ট গাছটি চিহ্নিত করতে পারিনি। তারপর একদিন শ্রদ্ধেয় নিসর্গী মোঃ মিজানুর রহমান আমাদেরকে জানালেন কেওড়ার সঙ্গে ‘কেওড়া জল’-এর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত বোতলবদ্ধ কেওড়ার জল কেওড়ার নয়, বরং কেয়া বা কেতকীর। এরপর প্রশ্ন দাঁড়ালো, কেতকী ফুল নাকি ফল থেকে এই কেওড়ার জল হয়। অবশেষে পাকা খবর পেয়েছি, পাতন পদ্ধতিতে কেয়ার ফুলের নির্যাস সংগ্রহ করেই তৈরি হয় কেওড়ার জল। কেওড়া জল প্রধানত উত্তর ভারতের সংস্কৃতির অংশ। পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারত ও বাংলাদেশে। পোলাও, বিরিয়ানি ছাড়াও রসমালাই ও রসগোল্লা, কেক, আইসক্রিম ইত্যাদি হালকা খাবারে কেওড়া জল ব্যবহারের চল আছে।

পোলাওপাতার পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নাম : Pandanus amaryllifolius Roxb. (1832)। সমনাম :  Pandanus hasskarlii Merr., Pandanus latifolius Hassk., Pandanus latifolius var. minor Hassk., Pandanus odorus Ridl.। ইংরেজিতে বলা হয় Pandan Leaves। পোলাওপাতার অন্যান্য নামগুলো হলো : Basmetrja Pauda (Bhojpuri), Hsun Hmway (Burmese), Qi Lan Ye (Chinese), Kewra (Hindi), Kevda (Hindi), Kevada (Hindi), Pandan Wangi (Indonesian), Sleuk (Khmer), Daun Pandan (Malay), Biriyanikaitha (Malayalam), Ambemohor Pat (Marathi), Rampe (Sinhala), Pandan (Tagalog), Ramba (Tamil), Bai Tooey (Thai), Dua Thơm (Vietnamese), La Nep (Vietnamese)।

কেয়া গোত্রের অন্যান্য সদস্যদের কোনো অংশ খাওয়া যায় কি না তাই ভাবছো তো! আমি সবার কথা জানি না। শুনেছি কেতকী (Pandanus tectorius)-এর কিছু চাষযোগ্য জাত তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সুন্দরবনের প্রজাতি দুটোর কথা যদি ভাবো তাহলে এখনই ক্ষান্ত দাও। আমি ও কথাই জিজ্ঞেস করেছিলাম মজিদ চাচাকে। আব্দুল মজিদ সরদার, তিনি চাচার হাত ধরে সুন্দরবনে বাওয়ালির কাজ শুরু করেছিলেন ১২ বছর বয়সে। বাঘে নিয়ে গেছে বাপ-চাচা দু’জনকেই। তারপরও ৪৬ বছর ধরে সুন্দরবনে কাঠ ও গোলপাতা কাটার কাজ করেন। গত ২০০৮ সাল থেকে কাঠ কাটা বন্ধ। মজিদ চাচা বললেন, “যহন মাংনির কাল ছেলো তহন গাঙ তত্ত্বড়ি (Suaeda maritima, মান বাংলায় নোনাগিরি বা চরগাদা) রাইন্ধে খাইছি চাকা চিংড়ে দিয়ে। মাঝে মাঝে বাউলির ফল, সফেদা বা কয়েৎবেলের মতো দেখতি, ওগুলো খাতাম। ওপরের খোসা ফেলায় দিলি একদম পেঁপেঁর মতো রাইন্ধে খায়া যায়। আর হেঁতালের মাথি। আর কোনো গাছে হাত দেবেন না। সারাগায়ে বিষ”! “কেয়াফল খাওয়া যায় না?” আমি প্রশ্ন করি। উৎকণ্ঠিত উত্তর পাই, “না না, খবরদার। জম্মের তিতে। সুন্দরবনে আর খায়া যায় কেওড়া আর ওড়ার ফল।” তাহলে বুঝতে পারছো অবস্থাটা!

তাহলে সুন্দরবনের প্রজাতি দুটো চিনে ফেলি। সেটা হয়তো খুব সহজ হবে তোমার জন্য।কেয়াকাঁটা বা কাইকি কাঁটার পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নাম Pandanus foetidus Roxb. (1832)। প্যান্ডানাস মানে তো আগেই বলেছি; ফোটিডা মানে হলো দুর্গন্ধ। কেয়াকাঁটার ফুলের গন্ধ তেমন একটা ভালো নয় বলেই এমন নাম। এর সমনামের মধ্যে আছে Benstonea foetida (Roxb.) Callm. & Buerki, Fisquetia macrocarpa Gaudich., Pandanus aurantiacus, Pandanus cyperaceus, Pandanus glaucus, Pandanus korthalsii, Pandanus wallichianus Martelli। ইংরেজি নাম Screw Pine, Pandan বা Screw Palm। অন্যান্য নামের ভেতরে রয়েছে Tawthagyet (Burmese), Thabaw (Burmese), Thagyet (Burmese), Kewra-kanta (Hindi) ও Kattukaitha (Malayalam)। একটা মালয় নাম দিতে পারলে খুব ভালো হতো, না? এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি, সোনা। পেলেই তোমাকে জানাবো।

কেয়া বা কেতকীর পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নাম Pandanus tectorius Parkinson ex Du Roi (1774)। টেকটোরিয়াস শব্দটির অর্থ ছাদের মতো আবৃত। কেয়াগাছের পাতা উপরে ছাদের মতো আচ্ছাদন তৈরি করে বলে একে টেকটোরিয়াস বলা হয়েছে। একটা জিনিস হয়তো তুমি জানো। তারপরেও আমি বলছি : বৈজ্ঞানিক নামের প্রথমাংশের (গণ) লৈঙ্গিক পরিচয় যা হবে প্রজাতির নামও সেই লিঙ্গের হতে হবে। প্যান্ডানাস শব্দটা পুংলিঙ্গ, তাই এর প্রজাতির নামও পুংলিঙ্গ। তেমনি ‘গণ’ স্ত্রীলিঙ্গ হলে প্রজাতিও স্ত্রীলিঙ্গ, গণ ক্লিব বা উভলিঙ্গের হলে প্রজাতিও তাই। বনেদি ভাষাগুলোতে যে কোনো নামের, এমনকি বস্তুরও, লিঙ্গান্তর করা যায়, এটাও তোমার জানার কথা।

যা হোক, গাছটার সমনাম আছে প্রায় শ’ খানেক। তার থেকে কয়েকটা তুলে দিচ্ছি : Corypha laevis (Lour.) A.Chev., Pandanus adscendens H.St.John, Pandanus bergmanii F.Br., Pandanus carolinensis Martelli, Pandanus cylindricus Kaneh., Pandanus fatyanion (Kaneh.) Hosok., Pandanus fragrans Gaudich., Pandanus inermis Roxb., Pandanus laevis Lour., Pandanus malatensis Blanco, Pandanus mei F.Br., Pandanus repens Miq., Pandanus sanderi Sander, Pandanus vangeertii auct.। স্থানীয় নামগুলো জানতে চাও? ইংরেজি নাম : Tahitian Screwpine, Pandan, Thatch Screwpine। অন্যান্য নাম : Kadi (Arabic), Kirjokairapalmu (Finnish), Kewra (Hindi), Panda Odorosa (Italian), Ketaki (Sanskrit)।

আচ্ছা, তুমি কি কখনও ভেবেছো, গাছপালার যেসব নাম মানুষ দিয়েছে তা কি গাছেরা পছন্দ করে? অধিকাংশ বাংলা নাম তবু সুন্দর, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছগুলোর যে নাম ইংরেজিভাষীরা দিয়েছে তা কোনো গাছের পছন্দ হবার কথা না। ধরো, কেওড়ার নাম দিলো White-flowered Crabapple। বাংলায় কী দাঁড়ায় নামটা? ধবলপুষ্পী কর্কটান্ন আপেল! এ নাম শুনেই তো গাছটার আত্মহত্যা করার কথা। কেন যে প্রকৃতি গাছদেরকে স্বসরণের অধিকার দেয়নি বুঝতে পারছো? স্বেচ্ছায় শুধু শাখা-প্রশাখা নাড়ানোর অধিকার থাকলেই পৃথিবীতে 'বৃক্ষাদি কর্তৃক খুনের ঘটনা' মহামারির আকার নিতো। যা-ই হোক, বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু জানিয়ে গেছেন যে 'অব্যক্ত' গাছেরও অনুভূতি আছে। তারপর বহু গবেষণা শেষে এও তো জানা গেছে যে শ্রুতিমধুর ছান্দিক গান শোনালে গাছ খুব দ্রুত বাড়ে। তার মানে গাছেরাও সঙ্গীতে সুরসিক। এখন একটা গবেষণা করে দেখা যেতে পারে : গাছগুলোকে যদি কাষ্ঠং শুষ্কং নামগুলো চব্বিশঘণ্টা আবৃত্তি করে শোনানো হয় তাহলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তারা? আমার জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি তো উদ্ভিদবিদ নই। তাই যথাযোগ্যরা সেটা করে দেখতে পারেন। 

গাছকে কেন অন্তত খানিকটা নড়াচড়ার ক্ষমতা দিলো না প্রকৃতি, সে প্রশ্ন বারংবার জাগে যখন যশোর থেকে কোলকাতার দিকে যাই। খুলনা থেকে একদম কোলকাতা পর্যন্ত সড়কটার নাম ‘যশোর রোড’ - এটা তো জানো। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়েছে এই সড়ক ধরে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা, “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড”, আর সেই গান গেয়ে বিখ্যাত হয়ে গেছেন ভারতীয় শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক। যশোরের জমিদার কালীপ্রসন্ন রায় ১৮৪০ থেকে ১৮৪২ সাল - এই দুই বছরে কয়েক হাজার শ্রমিক লাগিয়ে তাঁর শহর থেকে কোলকাতা পর্যন্ত একটা সড়ক নির্মাণ করেন। লোকে তাঁকে চিনতো কালী পোদ্দার নামে। তখন রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার শিরিষ গাছ লাগানো হয়। এই শিরিষ গাছগুলোর বয়স এখন প্রায় ১৮০ বছর। তুমি যদি পাশে গিয়ে দাঁড়াও তবে এদের আকার দেখেই ভয় লাগবে। কিন্তু মাঝে মাঝেই আইনি-বেআইনিভাবে গাছগুলোর ডাল কেটে নিয়ে যায় ক্ষমতাশালীরা। তখন আমার মনে হয়, যদি গাছগুলোর অন্তত এতটুকু অধিকার থাকতো যে, যেই গাছ কাটবে তার ঘাড়ে পড়ার অধিকার গাছটির থাকবে। তাহলেই হতো! 

ধান ভানতে শীবের গীত হয়ে গেল। আচ্ছা, এই ফাকে দু’জনের একটা বড়ো পার্থক্য বলে দেই। দু’জনেই গুল্ম হলেও কেতকীর রীতিমতো বৃক্ষের ন্যায় কাণ্ড ও শাখা হয়, যদিও তা উচ্চতার তুলনায় বেশ মোটা। অপরদিকে কেয়াকাঁটার বড় কাণ্ড হয় না। আরেকটু স্পষ্ট হতে চাও? কেয়া গাছের কাণ্ডের পাশ থেকে বড়ো আকারের ঠেসমূল বা বায়ুমূল হয়, কাইকি কাঁটায় তা একদম মাটির কাছাকাছি, তাই সাধারণভাবে দেখা যাবে না। কেতকীর পাতায় কাঁটা হয় খুব ছোট, জামাকাপড়ে লাগতে পারে, কিন্তু কেয়াকাঁটার কাঁটা বেশ বড়ো গায়ে লাগলে ছড়ে যাবে। কেয়াকাঁটার ফল ভীষণ তিতে, খাবার অযোগ্য, গন্ধও খারাপ; আর কেয়ার ফল অতোটা তিতে নয়, কিন্তু খাবার অযোগ্য, তবে গন্ধ ভালো। তবে তুমি গাছ দেখেই চিনতে পারবে, বাকি সব দেখতে হবে না। ওসব উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের কাজ, তাঁরাই ভালো পারবেন।

তোমার আবার এই কেওড়ার জল তৈরিতে মন দেয়ার দরকার নেই। তোমাকে যতোটুকু চিনি, কবে মনে হবে, দেখি আমিও পারি কিনা একটু সুগন্ধী জল তৈরি করতে?