সুন্দরবনের জলধারা

এই ঝোরাটা সুন্দরবনের নয়। ছবিটি তোলা হয়েছে রূপসা নদীর পাড় থেকে
 আঙ্গুরবালা, তোমার চোখের জল যেমন গাল বেয়ে নামতে থাকে শত নিয়ন্ত্রণের পরও নিয়ন্ত্রণহীন, তেমনি নামে শিসেগুলো বনের ভেতর থেকে। তারা বয়ে নিয়ে আসে বনের সব কান্না, সব ক্লান্তির অবশেষ। বনজীবীরা শিসে বলে বটে, তুমি হয়তো নালাই বলবে, অথবা বলবে নয়নজুলি। নয়নজুলি কাকে বলে জানো তো? গ্রামের রাস্তা করার জন্য রাস্তাটার দুইপাশের জমি কেটে মাটি তোলার পর যে নালাটা হয় সেটাকেই নয়নজুলি বলে লোকে।

বর্ষার জল জমে, ঘটে প্রস্বেদনের বারিপতন। আবার ভরা কটালের সময় দক্ষিণ দিক থেকে প্লাবনের মতো জল ঢোকে বনভূমিতে। সেই জল নামিয়ে নিয়ে যাবার জন্যই কাজ করে শিসেগুলো। অতিরিক্ত জল সরিয়ে বনকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে এরা, সেটাই এদের দায়িত্ব।

কোনো কোনো শিসে একেবারে একটা ছোটখাটো খালের মতো। তবে খালের সাথে শিসের পার্থক্য আছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা না থাকলে সেটা বোঝা খুব একটা সহজ নয়। শিসেগুলো জোয়ারের সময় পানিতে ভরা থাকলেও ভাটার সময় শুধু কাদা ছাড়া আর কিছু থাকে না। তাই মুখের দিকটা আটকে দিয়ে ছোট জেলেরা শিসে থেকে আকছার মাছ ধরে। কেউ কেউ ছোট খালগুলোতে বিষও ঢালে।

সে কথা থাক, শিসের বৈশিষ্ট্য না বুঝতে পারলে কী হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেই। ২০০৮ সালে আমরা কয়েকজন সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকেছি বন বিভাগের মৌখিক অনুমোদন নিয়ে। সঙ্গে দেশি বৈঠাওয়ালা নৌকা। হড্ডা খাল দিয়ে ঢুকে বামদিকে একটা শিসের মধ্যে ঢুকে গেছি। বনের ডাঙায় (বনজীবীরা বলে ‘মাল’) নেমেছি। বাইনের জরায়ূজ অঙ্কুর আর সুন্দরীর বীজ সংগ্রহ করছি।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। মাঝি ডাকছে। কিন্তু আমাদের সেদিকে নজর খুবই কম। মাঝি বলছে, “এরপর দেরি হলে কিন্তু ফিরতে পারবো না। এখানে বাঘের আনাগোনা আছে। বিপদে পড়ে যাবো।” কে শোনে কার কথা! এরই মধ্যে ভাটি হয়ে গেছে। মাঝির ধমকাধমকিতে আমরা নৌকায় উঠেছি। নৌকা যতো জোরে যাচ্ছে, তার চেয়েও দ্রুত কমে যাচ্ছে পানি। খালের মুখ থেকে পঞ্চাশ গজের মতো দূরে নৌকা রীতিমতো কাদায় আটকে গেল। ভয় আর রাগের মধ্যে আমরা দু’জন উরুসমান কাদায় নেমে নৌকা ঠেলে খালে নামালাম। ঘাম ছুটে গেল ভয়ে আর পরিশ্রমে।

ওই যে বলেছিলাম, নামহীন কতো কতো খাল মেলে একটা নামীয় খাল বা নদীর সঙ্গে, মনে পড়ে? তারপর আরো বলেছিলাম নদী থেকে একটা খাল সুন্দরবনের মধ্যে ঢুকে কয়েকটি খালে বিভক্ত হয়েছে, নাকি কয়েকটি খাল একত্রিত হয়ে একটি খালে রূপান্তরিত হয়েছে, তা বলা মুশকিল। মনে পড়ছে?

আমার মতে, বড়ো খাল আর নদীগুলো ওই নামহীন ছোট খালেরই সম্মিলিত রূপ। কিন্তু তুমি যদি ইংরেজি ভাষায় পড়তে চাও তাহলে মনে হবে, এগুলো বোধহয় জল বিতরণের পথ, ডিস্ট্রিবিউটরি। সেদিক দিয়েও চিন্তা করা যায়। কেননা বৃহত্তর জলধারা, মানে নদী বা গাঙ, উজান থেকে অনেক পানি বয়ে নিয়ে আসে। সেই পানি এসব শিসের মাধ্যমে ঢুকে যায় বনভূমির পরতে পরতে।

সুন্দরবনের জলধারার এমন বিভিন্ন স্থানীয় নাম আছে। প্রায়ই দেখবে এক একটা খালের নাম ভারানি – নীলকমল ভারানি, আদানিয়া ভারানি, বাইনতলা ভারানি, বাইসিং ভারানি, মান্দারবাড়িয়া ভারানি – এইরকম। খালের নাম আবার ভারানি কেন? এ প্রশ্ন জাগছে নিশ্চয়ই মনে? ভারানি হলো সেই জলধারা যেটি দুটো বৃহত্তর জলধারার সংযোগ ঘটিয়েছে। যেমন ধরো, দুটো সমান্তরাল নদী চলছে। কোনো এক জায়গায় একটা নদী থেকে খাল বেরিয়ে আরেকটা নদীতে মেশে। এটা একটা সংযোগ সেতুর মতো কাজ করে। এগুলোকেই ভারানি বলে।

আরেক ধরনের জলধারা আছে। সেগুলোকে বলে ‘দোয়ানি’। অপভ্রংশে ‘দুয়ানি’ বা ‘দোন’ও বলা হয়। বরগুনা শহরের ধার ঘেঁষে চলা মুল নদীটার নাম ‘খাকদোন’। বিষখালী নদীতে এসে মিশেছে নদীটা। উজানের অনেকগুলো খালের জল একত্রিত করে এসে ‘খাকদোন’ নদী তা বহন করে নিয়ে গেছে বিষখালী নদীতে। এরকম যেসব খাল বা ছোট নদী উজান থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট জলধারার জল বড়ো জলধারায় বয়ে নিয়ে আসে তাকে দোয়ানি বলা হয়। কাল দোয়ানি, মাদার দোয়ানি, মানকির দোয়ানি, মেঘনা দোয়ানি, সেঁজখালী দোয়ানি – এগুলো সুন্দরবনের মধ্যের দোয়ানি। এর বাইরেও চর দোয়ানির নাম আমি জানি।

আর আছে গাঙ আর নদী। নদীর তো আর সংজ্ঞা জানি না! গাঙ বোধহয় নদীকেই বলে। না? হ্যাঁ, নদীকেই গাঙ বলে তবে সুন্দরবনের এইসব অঞ্চলে গাঙ মানে একটু ছোট নদী।