কয়েক ঘণ্টার উদ্বাস্তু

আমেরিকান দম্পত্তিকে বললাম কথাটা। তারা ‘রাইট’ বলে হো হো করে হেসে উঠলেন। ঢাকা থেকে রওনা হবার পর সবকিছু ঠিকই ছিলো। গোল বাঁধলো যখন এসে কুনমিং পৌঁছলাম। ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশ বলে শুরুতেই এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছিলো। প্রায় পাঁচ কিমি রানওয়ে আর তার দ্বিগুণ ট্যাক্সিওয়ে পার হয়ে বিমানটা দাঁড়ালো। পেভমেন্টে না লাগিয়ে সিঁড়ি নামিয়ে দিলো অ্যাপ্রোন এলাকায়, তখনই আশঙ্কাটা বাস্তবের দিকে যেতে শুরু করলো। বুঝে ফেললাম, ফাইল আছে সামনে। যাঁরা কুনমিং-এর নানান জায়গায় যাবেন কাজে-অকাজে, সুন্দরী কমবয়সী বউকে অবিরল ধমকানো টুপিঅলা সাচিবিক ব্যক্তিটিসহ, তাঁরা তো চলেই গেলেন সোজা পথ ধরে। ঝামেলা বাঁধলো তাদের যারা বেরিয়ে যাবার লোক না, বরং আরো কিছুটা ঘোরাঘুরি আর শুয়েবসে তারপর যাবে ‘অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে’...

দানবীয় কাচারিঘরের মতো বিমানবন্দরটার নিচতলা দিয়ে যখন ঢুকলাম তখন জোরালো কণ্ঠ স্বাগত জানালো, “ধাকা তু কুনমিং, গো! ধাকা তু বেইজিং, গো দিস দিরেকসন!” একজন লোক বামদিকে পাঠিয়ে দিতে লাগলো। সকলে দল বেঁধে যখন চলতে শুরু করেছে তখনই, “নো নো, স্তপ, স্তপ।” হোয়াট হ্যাপেনড্? এ কোশ্চেনের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না, কিন্তু হাতে একটা ব্যাজ ধরিয়ে দেয়া হলো যা গলায় পরে দাঁড়াতে হবে। আগের বোর্ডিং পাস নিয়ে দেয়া হলো নতুন একটা। সব মিলিয়ে ১৭ জন যাত্রী। এঁরা আভ্যন্তরীণ বায়ুশকটে চড়ে অন্য কোথাও যেতে চান, বিশেষত বিশ্ব-কুবেরের রাজধানী বেইজিং-এ। যাত্রীদের মধ্যে বাঙালি বেশি বলেই বোধহয় একটা জটলা বেঁধে গেল। পাশ থেকে হাত এগিয়ে দেয়ার পর এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শুনলেন ধমক, “নো! ইউ গো লাইন। লাইন, লাইন!”

মনে পড়ে গেল, আব্দুস শাকুর একবার লিখেছিলেন : “সবকিছুরই লাইন আছে। লাইন দেবারও লাইন আছে।” যাক, লাইনে দাঁড়িয়ে নতুন বোর্ডিং পাওয়া গেল! এবার? একজন উর্দিঅলা লাইনের সামনে এলেন। নায়কী ভঙ্গিতে কাঁধের উপর থেকে হাতের ভঙ্গি করে বললেন, “ফলো মি”। এতক্ষণ সবার আগে ছিলাম যাতে পরিস্থিতি বুঝে পিছু হটে আসা যায়। এবার বুঝলাম, “দৌড়ের আগে আর মাইরের শেষে” নীতিই কাজে দিবে। তাই চলে এলাম ‘লাইন’-এর একদম শেষে। কয়েক পর্ব চলসিঁড়ি ও হাঁটাহাঁটি শেষে দেখা গেল সবাইকে ডানদিকের একটা দরোজা ঠেলে ঢুকছে। উর্দি বনাম উর্দি এক ধরনের আলোচনা চলতে থাকলো। কয়েক মিনিট পরে পুরো দলটা বেরিয়ে এলো এবং কমান্ডার ঘোষণা করলেন, “কাম, দিস ওয়ে”। পথ পাল্টে গেল। সুতরাং লিফো (LIFO) পদ্ধতির হিসেবে আমি সামনে চলে এলাম। সরু লম্বা লাইনটি চলতে থাকলো। কোনো এক জায়গায় এসে ইমিগ্রেশনের সামনে পড়া গেল। এখানেও পর্যাপ্ত ‘নো’, ‘হিয়ার’, ‘কাম’ ও ‘ফলো’ শোনা গেল।

শুরুতে জেনেছিলাম, বেইজিং গিয়ে ব্যাগেজ নিয়ে অন্য বিমানের বোর্ডিং নিতে হবে। কিন্তু অকুস্থলে বলা হলো, এখানেই ব্যাগেজ নিয়ে নিতে হবে এবং আবার চেক ইন করতে হবে। ত্যক্ত, বিরক্ত। ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের সামনে হাজির হলাম। আমি যে চীনে থাকবো না, বরং দক্ষিণ কোরিয়ার একটা ছোট্ট দ্বীপে যাবো, এবং সেজন্য আমার কাছে পর্যাপ্ত কাগজপত্র আছে সেটা বুঝাতে গিয়ে কালঘাম ছুটে গেল। আমার ধ্বসে পড়া ইংরেজি আর তার অবাধ্য কানের মাঝখানে ব্যাপক বাতচিৎ হলো। বিষয়টা অনেকটা ‘যেমন পাখভাঙা চিল, তেমন ঠ্যাঙভাঙা মুরগি’-এর মতো। ঘণ্টাখানেক পরে ২৪ ঘণ্টা থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। তারপর আরো ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে তবে ব্যাগটা পাওয়া গেল। এরপর আবার শুরু হলো, ‘ফলো মি’। লিফটে তিন তরফে উঠে পৌঁছানো গেল আরেকটি ফ্লোরে। তারপর আরো কিছু চলসিঁড়ি ও হাঁটাহাঁটি শেষে দেখা গেল আমরা আবার নির্ধারিত চেক ইন কাউন্টারে লম্বা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছি।

আবার চেক ইন, আবার সিকিউরিটি পার হয়ে তবে লাইন ধরে পৌঁছানো গেল বোর্ডিং লাউঞ্জে। লাইনে হাঁটতে হাঁটতেই প্রৌঢ় মার্কিন দম্পত্তিকে বললাম, “মনে হচ্ছে আমরা সিরিয়ান রিফিউজি, অ্যাসাইলামের জন্য দাঁড়িয়েছি জার্মানির সীমান্তে।” তাঁরা উচ্চশব্দে হাসলেন। কমান্ডার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। কিছু বুঝতে না পেরে পুনরায় বললেন, “ফলো মি!”

[বিমান যে এরপরে ৪ ঘণ্টা লেট ছিলো সেটা আপনাদের আর বললাম না!]