লালবাদার কাণ্ড দেখো



আঙ্গুরবালা, তুমি যদি নদীর পাড়ে চরের কাদার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াও তাহলে তোমাকে পা দুটো দু’দিকে একটু ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে ভারসাম্য থাকবে না, সামান্য ধাক্কা কিংবা বাতাসের তোড়েও তুমি পপাৎ ধরণীতল হতে পারো। সম্ভব হলে হাতে একটা গরানের ছিটে (লাঠির মতো মোটা কাণ্ড) নিয়ে নিও। তাহলে সব ধরনের ধাক্কা সামলাতে পারবে সহজে।

এই গাছটাও তেমনি। জোয়ারের পানি উঠে যায় তার কোমর পর্যন্ত। তারপর যখন-তখন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারোচ্ছ্বাস আর উজানের ঢল তো আছেই। পায়ের তলায় তার নেই শক্ত মাটি, পুরোটাই পলি – কখনও কখনও তাতে বালিও প্রচুর। জোয়ারভাটার কারণে পানির স্রোত প্রবল, স্থির হয়ে দাঁড়াবার জো-টি নেই। ওদিকে পেছন পেছন আসছে আরো আগ্রাসী গাছ, হরগজা, গেওয়া, কেওড়া; দ্রুত জায়গা বাড়াতে না পারলে এখানে টিকতে দেবে না তারা।

ওই যে রণপা’র মতো লম্বা লম্বা ধনুক-পা, ওগুলো দিয়ে চারপাশে ঠেকা দিয়ে নিজেকে সোজা করে রাখে সে। একটু স্থলে, মানে নদী থেকে ভেতরের দিকে যারা বাস করে তাদের কিন্তু এ ধরনের সহায়তা লাগে না। এই মূলগুলোকে তুমি বলবে ঠেসমূল। দেখেছো, মাত্র দু’ বছর বয়সে এই গাছটা শিখে গেছে কীভাবে কঠোর বাস্তবতায় টিকে থাকতে হবে। যতো বড়ো মুখ নয়, ততো বড়ো…। স্যরি, যতো বড়ো গাছ নয় ততো বড়ো শেকড়! যেন বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বীচি।

আরো আছে লবণাক্ততা। সাগরের ধার ঘেঁষে লবণাক্ততার মাত্রা সাধারণভাবেই ২০ পিপিটির (১) বেশি। এই তীব্র নোনায় অন্য কোনো গাছ বেড়ে ওঠা তো দূরের কথা, বীজই অঙ্কুরোদ্গম হয় না। আর যদি সাগরের জল কোথাও আটকে গিয়ে জলাশয় হয় তাহলে সেখানে লবণ কতোটা হয় ভাবতে পারো? তেজ কটাল বা জলোচ্ছ্বাসে নোনাজল ঢোকে ওই জলাশয়ে, তারপর রোদে জলটা দিব্যি উবে যায়, থেকে যায় লবণ। আবার নোনাজল ঢোকে, জল উবে যায়। রয়ে যায় লবণ। এভাবে ৩৫-৫০ পিপিটি পর্যন্ত পৌছে যায় লবণাক্ততা। এত লবণ কোথায় রাখবে গাছটা?

তারও একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেছে সে। পাতার গোড়ার দিকে একটা ছোট্ট গুঁটির মতো থলি বানিয়েছে। নোনাজল শুষে নিয়ে লবণটা ওই গুঁটির মধ্যে রেখে দেয়। তারপর মিষ্টি পানিটা নিজের কাজে লাগায়। পশুর, বাইন আর সুন্দরী এই কাজটা ভালো পারে না। তাই ওরা বুড়ো হতে হতে কাণ্ডের ভেতরে ফাপা হয়ে যায়।

কিন্তু সমস্যা আরেকটা আছে। নোনাপানি মানে তাতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কম। তাহলে বাঁচবে কী করে গাছটা? শ্বসন সালোক-সংশ্লেষণ তো চুলোয় উঠলো! এরকম সমস্যা একটু ভেতরের দিকের জলাভূমির (২) কাদাময় গাছগুলোরও আছে। সেজন্য ওই গাছগুলোর শ্বাসমূল বা শুলোও আছে। কিন্তু এ গাছগুলোর উপায়? তারও উপায় বের করেছে এই মহাফাজিল গাছগুলো। কী উপায়, বলো তো? ঠেসমূলগুলোর গা থেকে ঝুলিয়ে দেয় চিকণ চিকণ শেকড়। সেগুলো হলো বায়ুমূল।

এবার ভাবো, এই গাছটা যে জন্মালো, বীজটা এখানে এলো কী করে? সে আরেক কাহিনি। গাছটার ফুল থেকে যখন ফল হয় তখনই তার অঙ্কুরটাও হয়ে যায়। এগুলোকে বলে জরায়ূজ অঙ্কুর। মোটামুটি এক হাতের মতো লম্বা সূঁচালো একটা জরায়ূজ অঙ্কুর তিরিশ-চল্লিশ ফুট উপর থেকে যদি কাদামাটির মধ্যে পড়ে তখন কী হয় বুঝতে পারো তো? শেকড় না থাকলেও সে স্থায়ীভাবে সাকিন গড়ে নিলো নদীর পাড়ে। আর যদি তা না হয়ে পড়ে পানির মধ্যে, তাহলে? ফাঁপা, হালকা একটা ফল নির্বিবাদে ভেসে যায় পানির স্রোতের সাথে। তারপর যেখানে রাইত, সেখানেই কাইত। যে নদীর পাড়ে সে গিয়ে ঠেকবে, সেখানেই গড়ে তুলবে আপন ভূবন, ঘর-গেরস্ত।

আজকে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আমার এই বন্ধুকে। আমাদের দেশে এর নাম ঝানা। ইংরেজি নাম : Tall-stilt Mangrove বা Kandal। ভারতীয় সুন্দরবনে Rhizophora mucronata‘র মতো এটাকেও গর্জন বলে ডাকা হয়। কিন্তু উড়িয়া ভাষায় (ভারত) বলা হয় রাই (Rai)। তেলেগুতে (ভারত) উপ্পু পোন্না (Uppu Ponna), মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুরে বাকাউ মিনিয়াক (Bakau minyak) বা আকিত (Akit), মালদ্বীপে থাকাপাথি (Thakafathi) বা র‌্যানঢো (Randho), ফিলিপাইনে বাখাও লালাকি (Bakhaw Lalaki), ভিয়েতনামে ডুওক (Duoc) এবং ভার্জিন দ্বীপপূঞ্জে কোংকাং স্লেকটোচ (Kongkang-Slektoch) এর বৈজ্ঞানিক নাম : Rhizophora apiculata। এর গোত্রে নাম Rhizophoraceae।

১. পিপিটি মানে হলো পার্টস্ পার থাউজ্যান্ড; প্রতি হাজারে এক কণা। মানে, এক কেজি পানিতে যদি এক গ্রাম লবণ থাকে তবে লবণাক্ততার মাত্রা ১ পিপিটি বা ১০০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)।
২. বছরের একটা বড়ো অংশ কিংবা সময়ে সময়ে প্লাবিত থাকলেই জলাভূমি। পুরো সময় পানি থাকলে জলাশয়।