Sisters on New Year (নববর্ষে বোনেরা)

১৯৪৮ সালে জাপানের ওসাকায় একটা কোম্পানি কাজ শুরু করে। জাপানি কোম্পানি বলতে আমরা বুঝি টয়োটা, মিৎসুবিশি, শার্প, তোশিবা, ইসুজু, সুজুকি, নিপ্পন, হোন্ডা, ইয়ামাহা, ক্যানোন, ফুজিৎসু, নাইকন, ফুজি এইসব। এই কোম্পানিটা তার তুলনায় খুবই ছোটখাটো কোম্পানি। মাত্র ১ কোটি ইয়েন মূলধন নিয়ে শুরু করেছে যাত্রা। মানে, তখনকার টাকার মান অনুসারে ১০ লাখ টাকার বেশি না।

কোম্পানিটি পাঁচ বছর চলার পর প্রথমবারের মতো স্টক মার্কেটে আসতে পারলো। কোম্পানিটির নাম এনটি ইনকরপোরেটেড (NT Incorporated)। এতো ছোট কোম্পানির নাম নিশ্চয়ই কেউ শোনেন নি? শোনার কথাও না। আমাদের ঘরে যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায় তা এ কোম্পানি বানায় না। সব কোম্পানিই চায় এমন জিনিস বানাতে যা প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনে দরকারে পড়ে। বেশি টাকাওয়ালা কোম্পানিগুলো বানায় ফ্যান, ফ্রিজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার, গাড়ি। আরো বানায় ঘড়ি, কলম, ব্রিজ, জুতো, বিমান, জাহাজ এইসব। আর ছোট কোম্পানিগুলো খাবার-দাবার, মশলাপাতি, হাড়িপাতিল এইসব বিক্রি করতে চায়।

এ কোম্পানিটি কিন্তু সেদিক দিয়ে হাঁটলো না। কী তৈরি করলো বলতে পারেন? ছুরি। এমন এক ধরনের ছুরি নিয়ে এলো যা শুধুমাত্র কাগজ, পেন্সিল এইসব কাটার জন্য কাজে লাগবে। এই ছুরিটার বৈশিষ্ট্য হলো এর ব্লেড পাল্টে আবার নতুনের মতো ব্যবহার করা যায়। ব্লেডগুলোও সস্তা। ফলে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে গেল ছুরিগুলো। আর্টের ছেলেমেয়েরা তো বটেই, ছাত্র আর অফিসমাত্রেই যেন কয়েকটা এনটিকাটার থাকতেই হয়। এটাই স্টাইল।

স্টাইলটা এমন হলো যে, কেউ আর সেগুলোকে ছুরি বলে ডাকে না।  আঁঠা বা লেই কিনতে গিয়ে আমরা যেমন কোম্পানির নাম ধরে ডাকি, আইকা দেন তো! অথবা বলি ফেভিকল স্টিক দেন। অথচ বলা উচিৎ ছিলো গাম দেন বা গ্লু দেন। তেমনি এ কোম্পানির ছুরি কিনতে গিয়ে লোকে বলে এনটি কাটার দেন। আমি তো তরুণ বয়সে ভাবতাম “যত্রতত্র কেটেকুটে যাবার ভয় নেই বলে বোধহয় নাম এনটি কাটার (কর্তনরোধী)”! আপনারা নিশ্চয়ই তা ভাবতেন না!

গত বছর পয়লা বৈশাখে যখন আমাদের দেশের তরুণীরা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান আর টিএসসিতে যৌন নিপীড়নের শিকার হলো, তখন আমি ভাবছিলাম, আহা, ওই তরুণীদের সবার হাতে যদি ‘এল-৫০০’ বা ‘এল-৫৫০’ ব্র্যান্ডের একটা করে এনটি কাটার থাকতো। নিদেনপক্ষে যদি থাকতো ‘জি টাইপ’ বা ‘শার্প নাইফ’ ধরনের সস্তা এনটি কাটার! তাহলে ওই জঘন্য লোকগুলো তো কিছুটা শাস্তি পেতো। ওরা স্বভাবতই ভীতু ধরনের হয়। অপরাধ কর তো! অপরাধ করলে তো মনের সাহস কমে যায়।

তাই তক্ষুণি তক্ষুণি বোধহয় বলেছিলাম, সকল তরুণী কিশোরী নারীদের হাতে এনটি কাটার থাকা দরকার। আমার এক পরিচিত আপা এটা সঙ্গে রাখতেন। তাকে দেখেছি যে কোনো বিপদে সব সময় সাহসী। যে কোনো সমাবেশ, ভীড়ের জায়গায় সঙ্গে নিয়ে যেতেন আর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বেয়াদবদের থাপ্পড় দেয়াটা তার কাছে ছিলো ডালভাত।

এই আইডিয়াটা যখন শেয়ার করি তখন Ziaul Hoque Mukta ভাই বলেছিলেন, নব্বইয়ের দশকে ছাত্র সংগঠনের নেতারা মিলে পহেলা বৈশাখের অসভ্যদের শিক্ষাদানে কমিটির মতো কিছু একটা ছিলো। এই আইডিয়াটাও আমার পছন্দ হয়েছিলো। এরকম ইস্যুতে যে কেউ ডাক দিলে সব ছাত্র সংগঠনের নেতারা এ বিষয়ে তো এক হয়ে যাবার কথা, তাই না?

গত কিছুদিন ধরে কয়েকজন নারী ফেসবুকারদের দেখছি বাসের মধ্যে অশ্লীল আচরণের সম্মিলিত প্রতিবাদ করছেন। আমি ভীষণ উৎসাহিত আর আনন্দ পাই তাঁদের প্রতিবাদের নজির দেখে। এঁদের মধ্যে আমার কিছু ফেসবুক বন্ধুও আছেন। আপনারাও তো এক হয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকার একটা এনটি কাটার সঙ্গে রাখতে পারেন। দুর্ঘটনা ঘটার শুরুতেই বের করলে দেখবেন, ওই প্রাণীগুলো ভেঙেচুরে দৌঁড় দিচ্ছে।

আবারও বৈশাখ আসছে। আর মাত্র ৩ দিন পর। এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠনগুলা একসঙ্গে বসেছে কি না, জানি না। এখনও না বসে থাকলে একবার আলোচনায় বসা উচিৎ। গতবার ছাত্র ইউনিয়নের লিটন নন্দীরা ছিলো। ওরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। ওরা মানুষের দায়িত্বটুকু পালন করেছে। এবার সবাই মিলে চেষ্টা করুন না। মানুষের কাজটা সব ছাত্র সংগঠন মিলে হতে পারে না? পারে বলেই তো মনে হয়।

আর নারীদের বলছি। পুরুষ হিশেবে ক্ষমা চেয়েই বলছি : একটা এনটি কাটার কিনে হাতে রাখুন। না হয় অন্তত রাখুন জামা-প্যান্টের পকেটে। খবরদার, পার্সের মধ্যে ঢোকাবেন না। বের করতে সময় লাগবে।

শুভ নববর্ষ