জেজুর পথে

দক্ষিণ কোরিয়ার জেজুতে পৌঁছে ইমিগ্রেশন কর্তার সামনে যেতে যেতে আমার ভয়ই লাগছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম, ডানপাশের নারীকর্তার সামনে যেন পড়ি। তাহলে বাঁচার একটা উপায় পাওয়া যাবে। অভিজ্ঞতা বলছে, ইমিগ্রেশনে নারীকর্তারা পুরুষকর্তাদের তুলনায় আন্তরিক হন। তাঁরা অন্তত সমস্যাটা বলার সুযোগ দেন। আমার কাছে ভিসা-ফিসা নেই।

জীবনে প্রথমবার ভিসাহীন যাত্রা। না, প্রথমবার না। দ্বিতীয়বার। প্রথমবার ভিসা ছাড়া গিয়েছিলাম নেপালে। সে অবশ্য পুরো এক দঙ্গল মানুষ। আর ঢাকা বিমানবন্দরেও ঠকাস ঠকাস সিল মেরে দিলো। কিচ্ছু দেখলো না। হয়তো সার্কভুক্ত দেশ আর সকাল-বিকাল মানুষ যাচ্ছে যখন-তখন, তাই। কিন্তু এবার ঢাকায়ই আটকে দিলো দু’বার। প্রথমে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা বললেন, ভিসা ছাড়া আপনাকে বোর্ডিং পাস দিতে পারবো না। বেশ ধমকাধমকি করে, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি)’র নিবন্ধন ও আমন্ত্রণ, কোরিয়ান সরকারের পর্যটন বিভাগের অনাপত্তিপত্র, ফিরতি টিকেট ইত্যকার সব দলিল দস্তাবেজ দেখাতে হলো। সময় যেতে যেতে ভাবছিলাম এয়ারপোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করবো কি না। ইদানিংকালের ম্যাজিস্ট্রেট আর এবিপিএন-এর কর্মকর্তারা খুবই সহানুভূতিশীল। দু-একবার চাও খেতে গিয়েছি তাঁদের অফিসে। চমৎকার ব্যবহার আর আন্তরিক। নাহ্, তার আর দরকার হলো না। ইতোমধ্যে এয়ারলাইনের এক বড়োকর্তা এসে আমার কাগজপত্র দেখে বোর্ডিং পাস দিয়ে দিলেন।

কিন্তু গোল বাঁধলো ইমিগ্রেশনে গিয়ে। এ কর্তাটি আমার বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে পাসপোর্টে ভিসা না দেখে বইখানা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন ভিসার পেইজটা বের করে দেন। বুঝলাম, গ্যাঁড়ায় পড়তে যাচ্ছি। বিস্তারিত কাহিনি বললাম। তিনি পাসপোর্টখানা এমনভাবে পড়তে শুরু করলেন যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পড়ছেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন সঙ্গে এক স্যারকে নিয়ে। স্যারকে সন্তুষ্ট করতে আমাকে বেশ কসরৎ করতে হলো। স্যার সন্তুষ্ট হলেও হলেন না ইমিগ্রেশন অফিসার। তিনি আরো কিছুক্ষণ আমার পাসপোর্ট উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ফিরে এলে কিন্তু সব দায়দায়িত্ব আপনার! আমি ‘জ্বি আচ্ছা’ বলে মনে মনে হাসলাম। ভাবটা এমন যেন, আমাকে ডিপোর্ট করলে আবার ওঁকে দায় দায়িত্ব না নিতে হয়!

মূল সমস্যা হলো বিভূঁইয়ে চীনা ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে পড়ার পর। হায়, আমি কি আর জানতাম যে আমাকে চীনা আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও ব্যবহার করতে হবে! ঢাকা থেকে জানানো হলো যে বেইজিং পর্যন্ত আমার ব্যাগেজ সরাসরি চলে যাবে, সেখানে ব্যাগেজ সংগ্রহ করে আবার চেক-ইন করতে হবে দক্ষিণ কোরীয় এয়ারলাইন্সে। কিন্তু কুনমিং-এ পৌঁছাবার পরই জানানো হলো, ব্যাগেজ এখান থেকে সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে হবে এবং যেতে হবে ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্সে। সুতরাং লাইনে দাঁড়াতে হলো। সাহিত্যিক ও গোলাপ বিশেষজ্ঞ আব্দুস শাকুর দীর্ঘকাল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় মাস্টারি করেছেন, অনুবাদের কাজ করেছেন প্রাভদা ও প্রগতি প্রকাশনে। তিনি রাশিয়া প্রসঙ্গে একটা গল্পে বলেছেন, সবকিছুরই লাইন আছে; লাইন দেয়ারও লাইন আছে। চীনেও তা আছে বটে।

লাইন পার হয়ে যখন ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ালাম, তখন সেগুলোই আবার করতে হলো যা করে এসেছি। ভাগ্যিস আগে দু’বার আটকে দিয়েছিলো, তা না হলে আমি পত্রপাঠ ঢাকায় চলে আসবো বলেই ভাবতাম। বেশ কষ্ট হলো আমার ভাঙাচোরা ইংরেজি দিয়ে তাঁকে বোঝাতে যে আমি বৈধ অংশগ্রহণকারী এবং আমন্ত্রিত অতিথি। আমার কাগজগুলো তাঁর হাতে গেল। সেখান থেকে গেল আরেকজন উর্ধ্বতন কর্তার হাতে; কর্তার হাত থেকে তা দেয়ালের ওপারে কোথাও উধাও হয়ে গেল। ফিরে এলো মিনিট দশেক পর। ততোক্ষণে আমি ভেবে নিয়েছি, আজ রাতটা আন্তর্জাতিক যাত্রীদের সেকশনে কাটাতে হবে। কাল ভোরে সোজা ঢাকা। তারপর সবাইকে একটা মেইল পাঠাতে হবে, যাতে লেখা থাকবে, ‘স্যরি। চীনা সরকার আমাকে তাঁদের দেশ অতিক্রম করার অনুমতি না দেয়ায় এবার অংশ নিতে পারছি না। সো, নেক্সট টাইম।” কিন্তু মনে মনে ভাবছি, বিমান ভাড়ার টাকাটা কোত্থেকে পুষিয়ে নেয়া যায়! এই ফন্দি আঁটতে আঁটতে দেখি, ভদ্রলোক ফিরে এসেছেন এবং আমার পাসপোর্টে একটা