বিট্টুর গল্প
আঙ্গুরবালা, বিট্টু নেই। গতকাল রাতে যখন ঋষাৎ আর আমি রাস্তায় বেরিয়েছি, তখন বরাবরের মতো সে পেছন পেছন আসেনি। তার স্বভাবই হলো বন্ধু ঋষাৎ যখন বেরোবে, সঙ্গে সঙ্গে সেও বেরোবে। ঋষাৎ স্কুলে যাবে, সে স্কুলের ফটক পর্যন্ত গিয়ে বসে থাকবে। স্কুল ছুটি হলে ঋষাৎ প্রতিদিনের মতো রিক্সাভ্যানে উঠে বাড়ি আসবে। তার কি আর মনে থাকে যে, বিট্টু তার জন্য অপেক্ষা করছে! বয়রা বাসস্ট্যান্ডের যে মোড়টা, সেটা পার হবার পর হঠাৎ বিট্টু তাকে দেখতে পাবে। তারপর ইন্জিন লাগানো ভ্যানটার পেছনে পেছেনে দৌড়োতে থাকবে। ভ্যানে বসে বসেই ঋষাৎ বলবে, “দৌড়ানোর দরকার নাই। তুই আস্তে আস্তে আয়”। কিন্তু সে তা শুনবে না। দৌড়ে দৌড়েই বাড়ির ফটক পর্যন্ত আসবে।
গত বছর জানুয়ারিতে বিট্টু যখন আমাদের বাসায় এলো তখন আমার কোনো অনুভূতিই হয়নি। বাড়ির সকলে একটু বিরক্ত। নতুন একটা মুখ, খানিকটা বাড়তি দায়িত্ব; তার শোয়ার জায়গা, খাবার-দাবার – এইসব নানান ব্যবস্থাপনা। বরাবরই ঋষাৎই তার একমাত্র বন্ধু। বাকি সবাই হয় শত্রু অথবা নিরপেক্ষ সুশীল। সুতরাং ছোট্ট ঋষাৎ-এর ভালোবাসাটুকু নিয়েই সে মানিয়ে চলতে শুরু করলো। সেটা ছিলো আরেকটা শীতকাল, জানুয়ারি মাস। আমার তারিখ-ফারিক মনে নেই। ঋষাৎ বলছে, ৬ জানুয়ারি।
বিট্টু বারান্দাতেই বিছিয়ে দেয়া একটা ছালার উপর ঘুমাতো। প্রথম প্রথম তাকে সেটুকুও দেয়া হয়নি। নিতান্ত ঋষাৎ-এর চাপাচাপিতে একটা ছালা জুটলো বেশ কিছুদিন পর। মনে আছে, সে ঘুমিয়ে থাকতো আমাদের দরোজার সামনের পাপোশের উপর। আঙ্গুরবালা, তুমি তো জানো, আমি প্রায় সকালেই ঘুমোতে যাই। এক রাতের অন্ধকারে আমি অফিস থেকে ঘরে যাবার সময় বিট্টুর গায়ের উপর পা দিয়ে ফেললাম। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তারপর আমি যেমন সতর্ক হয়ে গেলাম, বিট্টুও। অফিসের দরোজা বন্ধ করার শব্দ পেলেই সে দরোজা ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি ঘরে ঢোকার পর আবার পাপোশের উপরই ঘুমোতো কি না, আমি জানি না।
কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখলাম, বিট্টু আর দরোজার সামনে ঘুমোয় না, বরং অফিসের দরোজার সামনে একটা বিছানো বস্তার উপর আরামসে ঘুমিয়ে থাকে। আমার ঢোকার বা বেরোবার সময় একটু মাথা তুলে দেখে, তারপর আবার ঘুমায়। দিনের বেলা কোথায় কোথায় থাকে, আমি জানি না। কিন্তু সন্ধ্যার পর যথারীতি তাকে দেখা যায় এক চিলতে বারান্দায়। ধীরে ধীরে তার জন্য একটা পাত্রের ব্যবস্থা হলো, তাও তার বন্ধুর ধারাবাহিক একগুঁয়েমির পর। বন্ধু তাকে স্নান করিয়ে দিতো টিউবওয়েলের ঘাটলায় নিয়ে। বন্ধুর নিতান্ত অকিঞ্চিতকর আদরে আপ্যায়নে তার আনন্দের সীমা ছিলো না। শান্তিতেই ছিলো সে।
বিট্টুর আচরণ নিয়ে আমি আগ্রহী হয়ে উঠলাম সেইদিন যেদিন শুনলাম ঋষাৎ-এর সঙ্গে সঙ্গে সে খেলাঘরে গিয়েছে। তারপর সেখানে সংগঠক রাজিব বিট্টুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। বিট্টু কিছুই করেনি। সে নিতান্ত গোবেচারা ধরনের। তারপরও নাকি রাজিব ওকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিকাল বেলাতেই নালিশ হলো। সন্ধ্যের মধ্যেই বিচার। রাজিব অবশ্য মারার অভিযোগটা অস্বীকার করেছে। কিন্তু ‘স্যরি’ তাকে বলতেই হলো।
কিন্তু সত্যিকারে অবাক হলাম আরেকদিন। ঋষাৎ আর আমি হাটে যাচ্ছিলাম সন্ধ্যের পর। দেখলাম বিট্টু পেছন পেছন আসছে। ঋষাৎকে বললাম, “ওকে বাড়ি যেতে বলো। রাস্তায় কোথায় হারিয়ে যাবে। শেষে আরেক যন্ত্রণা।” ঋষাৎ বললো, “পরশুদিন আমার সঙ্গে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের মোড় পর্যন্ত গিয়েছিলো। তারপর ওর বন্ধুরা আবার পৌঁছে দিয়েছে।” আমি অবাক! বলে কী! সুতরাং বিট্টু আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকলো। সতর্ক হয়ে রাস্তা পার হলো। তারপর কাচা বাজারে লোকের ভীড় ঠেলে, এর ওর লাথিটাথি খেয়েও শেষ পর্যন্ত লাবলু ভাইয়ের দোকান ‘সেফ অ্যাগ্রো’তে ঠিক ঠিক পৌঁছে গেল। আমরা দোকানের বারান্দায়, বিট্টু রাস্তার পাশে। আরেক দোকান থেকে দু’ প্যাকেট বিস্কুট কিনে তাকে দিলে মজা করে খেলো। তারপর আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো বাড়িতে।
পরের দিন বিট্টুর ধৈর্য্য পরীক্ষা করার জন্য আমি প্রথমে গেলাম পলাশের দোকান ‘ইজি বাই’তে, সেখান থেকে মার্কেটের ভেতর দিয়ে এলাম কাচা বাজারে, সবশেষে গেলাম সেফ অ্যাগ্রোতে। ও মা! সেও একই পথ ধরে ঠিক আমাদের পেছন পেছন সোজা গন্তব্যে হাজির হলো। আসার সময় কিছুদুর এগিয়ে আর দেখি না! কোথায় গেল, কোথায় গেল? দু’জনে একপাক খুঁজলাম। নেই, কোত্থাও নেই। কিন্তু বাড়ি আসার কিছুক্ষণ পর সেও হাজির। এবার ঋষাৎ তাকে জেরা করতে শুরু করলো। বরাবরের মতোই বিনম্র বিট্টু চুপচাপ সকল ধমক শুনে গেল কোনো উত্তর ছাড়াই।
আঙ্গুরবালা, ওর নাম কিন্তু শুরুতে বিট্টু ছিলো না। বাবা-মায়ের দেয়া নাম যে কী ছিলো, কে জানে! আমাদের বাড়িতে আসার পর তার একটা নাম খুব জরুরি হয়ে গেল। পালনকর্তা আমার কাছে চলে এলেন ইন্টারনেট ঢুঁড়ে একটা নাম বের করার জন্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নাম হলো ‘স্পাইক’। কিন্তু কালে কালে তার নাম পাল্টে হয়ে গেলো ‘বিট্টু’। ঋষাৎকে জিজ্ঞেস করো, বলবে, “অন্যদের মতো বাড়ে না যে তাই নাম বিট্টু। আমি কিন্তু এসব নামের ধার ধারিনি। ডাকলেই চলে আসতো কাছে, তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো সামনে, পরে কী বলবো তাই শোনার জন্য।
বন্ধুর সামনে বিট্টু আলাভোলার মতো থাকলেও বন্ধুর মায়ের সঙ্গে সে ফাজলামো করতে ছাড়তো না। একদিন ঋষাৎ আমাকে এসে বলছে, “বিট্টু কতোটা ফাজিল হয়েছে তুমি জানো?” আমি বললাম, “না তো! কী হয়েছে?” “শোনো”, ঋষাৎ বলছে, “আম্মু ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ময়লা ফেলছে আর বিট্টু তা বের করে করে নিচে ফেলছে। আম্মু আবার তুলে বাস্কেটে রাখছে। বিট্টু আবার তা নিচে ফেলে দিচ্ছে। শেষমেষ আম্মুর ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা হয়েছে”। এমন হতো প্রায়ই। আমি অ্যাশট্রে থেকে সিগারেটের বাট নর্দমায় ফেলতে গেলে বিট্টু গদাইলস্করি চালে উঠতো। গেটের বাইরে বাটগুলো ফেলে আসার পর সেও গেটের বাইরে যেতো। তারপর কী করেছি সেটা দেখে আবার এসে বসতো নিজের জায়গায়। যেন আমি কী করি না করি সেটা দেখাই তার দায়িত্ব।
মোট কথা ঋষাৎ-ই ছিলো বিট্টুর পরম বন্ধু। সে যেখানেই যাক না কেন, সে খেলতে বা বেড়াতে, তার সঙ্গে যাওয়া চাই। রাস্তায় অন্যদের সঙ্গে সে লড়াইয়ে পারতো না। আর তুমি জানো তো, আঙ্গুরবালা, সব স্তন্যপায়ী প্রাণীরই নিজস্ব এলাকা থাকে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নিশে’। অন্যের নিশে’তে ঢুকে বিট্টু বরাবরই সংঘর্ষ এড়াতে চাইতো। নিতান্ত না পারলে প্রথমে ঋষাৎ-এর সাহায্য চাইতো। তারপর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কোনোমতে অকুস্থল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতো। তবে ঋষাৎ ছাড়াও কয়েকজন বন্ধু হয়েছিলো তার। পাড়ায় একজন তো ছিলোই। আর দু’জন ছিলো বয়রা বাজারের মোড়ে। তারা নাকি বিট্টুকে পথ চিনিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতো, এমনই ঋষাৎ-এর বিশ্বাস।
তবে নিটোল বন্ধুত্ব তো হয় না আর কি। অন্তত সরল জীবনে হয় না, জীবন-ভাবনা এসব একটু পালিশ করেই নিটোল বন্ধুত্ব বলতে হয়। বিট্টুর খাবারে ভাগ বসাতো তার বন্ধুরা। বিট্টু সেটা খুব একটা পছন্দ না করলেও তেমন প্রতিবাদও করতো না। খাবারের একটা নিশ্চয়তা তার ছিলো, তাই হয়তো। আঙ্গুরবালা, জীবন যতো বেশি অনিশ্চিত, সংঘর্ষ ততো বেশি অনিবার্য। আমরা অনেকগুলো বিকল্প ভেবে সংঘর্ষগুলো এড়িয়ে যাই। সবার পক্ষে তো সেটা সম্ভব হয় না। সেটাও ইচ্ছে করে করে তা কিন্তু নয়। সংঘর্ষ হয় কেননা যুযূধান কোনো একটি পক্ষের কোনো বিকল্প থাকে না। তাই অন্তর্নিহিত কারণটা খুঁজতে যাওয়া বা না যাওয়ায় কিছুই আসে যায় না। শুধু নিরুপায় পক্ষটির কথা ভাবলেই চলে।
এভাবে বিট্টু গোত্রের অংশ হয়ে ওঠে। বিট্টুকে রাতে বারান্দায় না দেখা গেলে বাবা জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বিট্টু খুব ফাজিল হয়েছে। এখানে ওখানে রাত কাটায়”। বিট্টুকে আবার রক্ষা করে তার পরম বন্ধু, “বারান্দায় ভীষণ ঠাণ্ডা। ও তাই খড়ের পালার মধ্যে ঘুমায়”। আমিও ছোটবেলায় শীতের রাতে বেশ কয়েকবার খড়ের পালার মধ্যে ঘুমোতে গিয়েছি। কিন্তু গরম লাগার পাশাপাশি মিথেন গ্যাসের কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া খড় গায়ে লাগলে চুলকায়ও প্রচুর। খোলা আকাশের নিচে কুটোর মধ্যে ঘুমোতে গিয়েই বিট্টুর ঠাণ্ডা লাগে। সুতরাং ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করে ওষুধও আনানো হয়। ওষুধ খাওয়ায় তারই বন্ধু ঋষাৎ।
আমি গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় গেলাম, তুমি জানো আঙ্গুরবালা। সেদিনই বিট্টুকে ঋষাৎ একটা চশমা পরিয়ে দিয়েছিলো। সেটা পরে নাকি সে অস্বস্তিতে লাফালাফি করছিলো। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে একটা টেলিফোন পাই, ঋষাৎ নাকি কাঁদছে; কিছুতেই কান্না থামানো যাচ্ছে না। ঋষাৎ-এর সাথে কথা বলে জানতে পারি, ২৭ তারিখ থেকে বিট্টুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থেকে ঋষাৎও ভাত খেতে গেলেই কাঁদে। মাংসের ঝোল দিয়ে ক’টা ভাত আর কিছু হাড্ডি বরাবরই বিট্টুকে দিতো সে। নিজের অংশ থেকে তো দিতোই কখনও কখনও চেয়েচিন্তেও জোগাড় করতো বিট্টুর জন্য খাবার। নিজে খেতে গেলেই বিট্টুর কথা মনে পড়ছে, আর সে খেতে পারছে না। হাউমাউ করে কাঁদছে। শুধু বলছে, “কাকে আমি বিট্টু বলে ডাকবো?”
আঙ্গুরবালা, তুমি হয়তো বলবে, এ আর এমন কী? একটুখানি কাঁদছে, এক সময় থেমে যাবে। খুবই সত্য। কিন্তু ওই শিশুটার কান্না দেখে যে আমারও কান্না পায়! আমি যে চায়ের দোকানে গিয়ে ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখি, এই কি আমাদের বিট্টু? নাহ! বিট্টুর কান বড়ো আর ভাঙা, এর কান ছোট। এরকম হয় কেন? কিন্তু তোমার কথাই ঠিক। একদিন থেমে যাবে সব কান্না। তুমি এভাবেই বলতে পারবে কেননা তুমি ঘটনাটাকে দেখ একটি কোনা থেকে যে কোনা থেকে আমি দেখি না। আমি যেখান থেকে দেখি সেখানে ঋষাৎ থাকে, তার আবেগ থাকে, আমার প্রাত্যাহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে। তোমার সেটা থাকে না। তাই প্রত্যেকেই ঠিক। তোমার যুক্তিও ঠিক, ঋষাৎ-এর আবেগও। আমি তাই কোনোটাকেই বিচার করতে পারি না। আমি শুধু ভাবি, ভিন্নমত-ভিন্নতা-ভিন্ন ভাবনা।
ঋষাৎ বিশ্বাস করে না যে বিট্টু আর আসবে না। সে ভাবছে, বিট্টুকে কেউ আটকে রেখেছে ওর সুন্দর চেহারা আর নম্রতা দেখে। শেকল দিয়ে আটকে রেখেছে হয়তো বাড়ির ভেতরে। গতকাল তাই আমি আর ও বিট্টুকে খুঁজতে গিয়েছিলাম কয়েকটি রাস্তায়। যাকেই দেখি ঋষাৎ একটু বেশিক্ষণ নজর দিয়ে দেখে। তারপর বলে, “এ না। বিট্টু হলে এতক্ষণ দৌঁড়ে চলে আসতো। আর এরও কান ছোট।” আজ কেউ একজন ওকে বলেছে মধ্যপাড়ায় বিট্টুর মতো কাউকে দেখেছে। সকালে তাই আমরা মধ্যপাড়া যাবো ঢাকায় যাবার আগে। কিন্তু আরো কঠিন সংবাদ আমরা জেনেছি। সদর রাস্তার ধারের লোকজন বলেছে, বিট্টু একটা চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়েছে। তারপর তার নাম হয়ে গেছে ‘লাশ’। সেই লাশ সরিয়ে নিয়ে গেছে নগর কর্তৃপক্ষের মেথররা।
ট্রাকের নিচে পড়লে পাঁজর ভাঙায় কেমন ব্যথা লাগে, সে কি তা জানতো? নইলে কি সে চিন্তা করছিলো, আমার এমন লাগছে কেন? চাকার নিচে পড়ার পর বিট্টু কী বলতে চেয়েছিলো? ওর করুণ চোখটা কেমন দেখতে হয়েছিলো? ও কি সঙ্গে সঙ্গে মরে গিয়েছিলো? তুমি জানো আঙ্গুরবালা? সে কি শেষ কয়েক মুহূর্ত বন্ধুকে দেখতে চেয়েছিলো? ‘মরে যাওয়া’ কী তা কি বিট্টু জানতো? ধীরে ধীরে যখন তার জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো, তখন কী ভাবছিলো ছোট্ট বিট্টু? বিট্টুকে কেউ কোনোদিন ক্রিসম্যাসে সাজিয়ে দেয়নি; ওর কি একবার সাজতে ইচ্ছে হয়েছিলো?
বিট্টু আর ফিরবে না কোনোদিন।
গত বছর জানুয়ারিতে বিট্টু যখন আমাদের বাসায় এলো তখন আমার কোনো অনুভূতিই হয়নি। বাড়ির সকলে একটু বিরক্ত। নতুন একটা মুখ, খানিকটা বাড়তি দায়িত্ব; তার শোয়ার জায়গা, খাবার-দাবার – এইসব নানান ব্যবস্থাপনা। বরাবরই ঋষাৎই তার একমাত্র বন্ধু। বাকি সবাই হয় শত্রু অথবা নিরপেক্ষ সুশীল। সুতরাং ছোট্ট ঋষাৎ-এর ভালোবাসাটুকু নিয়েই সে মানিয়ে চলতে শুরু করলো। সেটা ছিলো আরেকটা শীতকাল, জানুয়ারি মাস। আমার তারিখ-ফারিক মনে নেই। ঋষাৎ বলছে, ৬ জানুয়ারি।
বিট্টু বারান্দাতেই বিছিয়ে দেয়া একটা ছালার উপর ঘুমাতো। প্রথম প্রথম তাকে সেটুকুও দেয়া হয়নি। নিতান্ত ঋষাৎ-এর চাপাচাপিতে একটা ছালা জুটলো বেশ কিছুদিন পর। মনে আছে, সে ঘুমিয়ে থাকতো আমাদের দরোজার সামনের পাপোশের উপর। আঙ্গুরবালা, তুমি তো জানো, আমি প্রায় সকালেই ঘুমোতে যাই। এক রাতের অন্ধকারে আমি অফিস থেকে ঘরে যাবার সময় বিট্টুর গায়ের উপর পা দিয়ে ফেললাম। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তারপর আমি যেমন সতর্ক হয়ে গেলাম, বিট্টুও। অফিসের দরোজা বন্ধ করার শব্দ পেলেই সে দরোজা ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি ঘরে ঢোকার পর আবার পাপোশের উপরই ঘুমোতো কি না, আমি জানি না।
কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখলাম, বিট্টু আর দরোজার সামনে ঘুমোয় না, বরং অফিসের দরোজার সামনে একটা বিছানো বস্তার উপর আরামসে ঘুমিয়ে থাকে। আমার ঢোকার বা বেরোবার সময় একটু মাথা তুলে দেখে, তারপর আবার ঘুমায়। দিনের বেলা কোথায় কোথায় থাকে, আমি জানি না। কিন্তু সন্ধ্যার পর যথারীতি তাকে দেখা যায় এক চিলতে বারান্দায়। ধীরে ধীরে তার জন্য একটা পাত্রের ব্যবস্থা হলো, তাও তার বন্ধুর ধারাবাহিক একগুঁয়েমির পর। বন্ধু তাকে স্নান করিয়ে দিতো টিউবওয়েলের ঘাটলায় নিয়ে। বন্ধুর নিতান্ত অকিঞ্চিতকর আদরে আপ্যায়নে তার আনন্দের সীমা ছিলো না। শান্তিতেই ছিলো সে।
বিট্টুর আচরণ নিয়ে আমি আগ্রহী হয়ে উঠলাম সেইদিন যেদিন শুনলাম ঋষাৎ-এর সঙ্গে সঙ্গে সে খেলাঘরে গিয়েছে। তারপর সেখানে সংগঠক রাজিব বিট্টুর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। বিট্টু কিছুই করেনি। সে নিতান্ত গোবেচারা ধরনের। তারপরও নাকি রাজিব ওকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিকাল বেলাতেই নালিশ হলো। সন্ধ্যের মধ্যেই বিচার। রাজিব অবশ্য মারার অভিযোগটা অস্বীকার করেছে। কিন্তু ‘স্যরি’ তাকে বলতেই হলো।
কিন্তু সত্যিকারে অবাক হলাম আরেকদিন। ঋষাৎ আর আমি হাটে যাচ্ছিলাম সন্ধ্যের পর। দেখলাম বিট্টু পেছন পেছন আসছে। ঋষাৎকে বললাম, “ওকে বাড়ি যেতে বলো। রাস্তায় কোথায় হারিয়ে যাবে। শেষে আরেক যন্ত্রণা।” ঋষাৎ বললো, “পরশুদিন আমার সঙ্গে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের মোড় পর্যন্ত গিয়েছিলো। তারপর ওর বন্ধুরা আবার পৌঁছে দিয়েছে।” আমি অবাক! বলে কী! সুতরাং বিট্টু আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকলো। সতর্ক হয়ে রাস্তা পার হলো। তারপর কাচা বাজারে লোকের ভীড় ঠেলে, এর ওর লাথিটাথি খেয়েও শেষ পর্যন্ত লাবলু ভাইয়ের দোকান ‘সেফ অ্যাগ্রো’তে ঠিক ঠিক পৌঁছে গেল। আমরা দোকানের বারান্দায়, বিট্টু রাস্তার পাশে। আরেক দোকান থেকে দু’ প্যাকেট বিস্কুট কিনে তাকে দিলে মজা করে খেলো। তারপর আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো বাড়িতে।
পরের দিন বিট্টুর ধৈর্য্য পরীক্ষা করার জন্য আমি প্রথমে গেলাম পলাশের দোকান ‘ইজি বাই’তে, সেখান থেকে মার্কেটের ভেতর দিয়ে এলাম কাচা বাজারে, সবশেষে গেলাম সেফ অ্যাগ্রোতে। ও মা! সেও একই পথ ধরে ঠিক আমাদের পেছন পেছন সোজা গন্তব্যে হাজির হলো। আসার সময় কিছুদুর এগিয়ে আর দেখি না! কোথায় গেল, কোথায় গেল? দু’জনে একপাক খুঁজলাম। নেই, কোত্থাও নেই। কিন্তু বাড়ি আসার কিছুক্ষণ পর সেও হাজির। এবার ঋষাৎ তাকে জেরা করতে শুরু করলো। বরাবরের মতোই বিনম্র বিট্টু চুপচাপ সকল ধমক শুনে গেল কোনো উত্তর ছাড়াই।
আঙ্গুরবালা, ওর নাম কিন্তু শুরুতে বিট্টু ছিলো না। বাবা-মায়ের দেয়া নাম যে কী ছিলো, কে জানে! আমাদের বাড়িতে আসার পর তার একটা নাম খুব জরুরি হয়ে গেল। পালনকর্তা আমার কাছে চলে এলেন ইন্টারনেট ঢুঁড়ে একটা নাম বের করার জন্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নাম হলো ‘স্পাইক’। কিন্তু কালে কালে তার নাম পাল্টে হয়ে গেলো ‘বিট্টু’। ঋষাৎকে জিজ্ঞেস করো, বলবে, “অন্যদের মতো বাড়ে না যে তাই নাম বিট্টু। আমি কিন্তু এসব নামের ধার ধারিনি। ডাকলেই চলে আসতো কাছে, তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো সামনে, পরে কী বলবো তাই শোনার জন্য।
বন্ধুর সামনে বিট্টু আলাভোলার মতো থাকলেও বন্ধুর মায়ের সঙ্গে সে ফাজলামো করতে ছাড়তো না। একদিন ঋষাৎ আমাকে এসে বলছে, “বিট্টু কতোটা ফাজিল হয়েছে তুমি জানো?” আমি বললাম, “না তো! কী হয়েছে?” “শোনো”, ঋষাৎ বলছে, “আম্মু ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ময়লা ফেলছে আর বিট্টু তা বের করে করে নিচে ফেলছে। আম্মু আবার তুলে বাস্কেটে রাখছে। বিট্টু আবার তা নিচে ফেলে দিচ্ছে। শেষমেষ আম্মুর ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা হয়েছে”। এমন হতো প্রায়ই। আমি অ্যাশট্রে থেকে সিগারেটের বাট নর্দমায় ফেলতে গেলে বিট্টু গদাইলস্করি চালে উঠতো। গেটের বাইরে বাটগুলো ফেলে আসার পর সেও গেটের বাইরে যেতো। তারপর কী করেছি সেটা দেখে আবার এসে বসতো নিজের জায়গায়। যেন আমি কী করি না করি সেটা দেখাই তার দায়িত্ব।
মোট কথা ঋষাৎ-ই ছিলো বিট্টুর পরম বন্ধু। সে যেখানেই যাক না কেন, সে খেলতে বা বেড়াতে, তার সঙ্গে যাওয়া চাই। রাস্তায় অন্যদের সঙ্গে সে লড়াইয়ে পারতো না। আর তুমি জানো তো, আঙ্গুরবালা, সব স্তন্যপায়ী প্রাণীরই নিজস্ব এলাকা থাকে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নিশে’। অন্যের নিশে’তে ঢুকে বিট্টু বরাবরই সংঘর্ষ এড়াতে চাইতো। নিতান্ত না পারলে প্রথমে ঋষাৎ-এর সাহায্য চাইতো। তারপর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কোনোমতে অকুস্থল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতো। তবে ঋষাৎ ছাড়াও কয়েকজন বন্ধু হয়েছিলো তার। পাড়ায় একজন তো ছিলোই। আর দু’জন ছিলো বয়রা বাজারের মোড়ে। তারা নাকি বিট্টুকে পথ চিনিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতো, এমনই ঋষাৎ-এর বিশ্বাস।
তবে নিটোল বন্ধুত্ব তো হয় না আর কি। অন্তত সরল জীবনে হয় না, জীবন-ভাবনা এসব একটু পালিশ করেই নিটোল বন্ধুত্ব বলতে হয়। বিট্টুর খাবারে ভাগ বসাতো তার বন্ধুরা। বিট্টু সেটা খুব একটা পছন্দ না করলেও তেমন প্রতিবাদও করতো না। খাবারের একটা নিশ্চয়তা তার ছিলো, তাই হয়তো। আঙ্গুরবালা, জীবন যতো বেশি অনিশ্চিত, সংঘর্ষ ততো বেশি অনিবার্য। আমরা অনেকগুলো বিকল্প ভেবে সংঘর্ষগুলো এড়িয়ে যাই। সবার পক্ষে তো সেটা সম্ভব হয় না। সেটাও ইচ্ছে করে করে তা কিন্তু নয়। সংঘর্ষ হয় কেননা যুযূধান কোনো একটি পক্ষের কোনো বিকল্প থাকে না। তাই অন্তর্নিহিত কারণটা খুঁজতে যাওয়া বা না যাওয়ায় কিছুই আসে যায় না। শুধু নিরুপায় পক্ষটির কথা ভাবলেই চলে।
এভাবে বিট্টু গোত্রের অংশ হয়ে ওঠে। বিট্টুকে রাতে বারান্দায় না দেখা গেলে বাবা জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বিট্টু খুব ফাজিল হয়েছে। এখানে ওখানে রাত কাটায়”। বিট্টুকে আবার রক্ষা করে তার পরম বন্ধু, “বারান্দায় ভীষণ ঠাণ্ডা। ও তাই খড়ের পালার মধ্যে ঘুমায়”। আমিও ছোটবেলায় শীতের রাতে বেশ কয়েকবার খড়ের পালার মধ্যে ঘুমোতে গিয়েছি। কিন্তু গরম লাগার পাশাপাশি মিথেন গ্যাসের কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া খড় গায়ে লাগলে চুলকায়ও প্রচুর। খোলা আকাশের নিচে কুটোর মধ্যে ঘুমোতে গিয়েই বিট্টুর ঠাণ্ডা লাগে। সুতরাং ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করে ওষুধও আনানো হয়। ওষুধ খাওয়ায় তারই বন্ধু ঋষাৎ।
আমি গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় গেলাম, তুমি জানো আঙ্গুরবালা। সেদিনই বিট্টুকে ঋষাৎ একটা চশমা পরিয়ে দিয়েছিলো। সেটা পরে নাকি সে অস্বস্তিতে লাফালাফি করছিলো। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে একটা টেলিফোন পাই, ঋষাৎ নাকি কাঁদছে; কিছুতেই কান্না থামানো যাচ্ছে না। ঋষাৎ-এর সাথে কথা বলে জানতে পারি, ২৭ তারিখ থেকে বিট্টুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থেকে ঋষাৎও ভাত খেতে গেলেই কাঁদে। মাংসের ঝোল দিয়ে ক’টা ভাত আর কিছু হাড্ডি বরাবরই বিট্টুকে দিতো সে। নিজের অংশ থেকে তো দিতোই কখনও কখনও চেয়েচিন্তেও জোগাড় করতো বিট্টুর জন্য খাবার। নিজে খেতে গেলেই বিট্টুর কথা মনে পড়ছে, আর সে খেতে পারছে না। হাউমাউ করে কাঁদছে। শুধু বলছে, “কাকে আমি বিট্টু বলে ডাকবো?”
আঙ্গুরবালা, তুমি হয়তো বলবে, এ আর এমন কী? একটুখানি কাঁদছে, এক সময় থেমে যাবে। খুবই সত্য। কিন্তু ওই শিশুটার কান্না দেখে যে আমারও কান্না পায়! আমি যে চায়ের দোকানে গিয়ে ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখি, এই কি আমাদের বিট্টু? নাহ! বিট্টুর কান বড়ো আর ভাঙা, এর কান ছোট। এরকম হয় কেন? কিন্তু তোমার কথাই ঠিক। একদিন থেমে যাবে সব কান্না। তুমি এভাবেই বলতে পারবে কেননা তুমি ঘটনাটাকে দেখ একটি কোনা থেকে যে কোনা থেকে আমি দেখি না। আমি যেখান থেকে দেখি সেখানে ঋষাৎ থাকে, তার আবেগ থাকে, আমার প্রাত্যাহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে। তোমার সেটা থাকে না। তাই প্রত্যেকেই ঠিক। তোমার যুক্তিও ঠিক, ঋষাৎ-এর আবেগও। আমি তাই কোনোটাকেই বিচার করতে পারি না। আমি শুধু ভাবি, ভিন্নমত-ভিন্নতা-ভিন্ন ভাবনা।
ঋষাৎ বিশ্বাস করে না যে বিট্টু আর আসবে না। সে ভাবছে, বিট্টুকে কেউ আটকে রেখেছে ওর সুন্দর চেহারা আর নম্রতা দেখে। শেকল দিয়ে আটকে রেখেছে হয়তো বাড়ির ভেতরে। গতকাল তাই আমি আর ও বিট্টুকে খুঁজতে গিয়েছিলাম কয়েকটি রাস্তায়। যাকেই দেখি ঋষাৎ একটু বেশিক্ষণ নজর দিয়ে দেখে। তারপর বলে, “এ না। বিট্টু হলে এতক্ষণ দৌঁড়ে চলে আসতো। আর এরও কান ছোট।” আজ কেউ একজন ওকে বলেছে মধ্যপাড়ায় বিট্টুর মতো কাউকে দেখেছে। সকালে তাই আমরা মধ্যপাড়া যাবো ঢাকায় যাবার আগে। কিন্তু আরো কঠিন সংবাদ আমরা জেনেছি। সদর রাস্তার ধারের লোকজন বলেছে, বিট্টু একটা চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়েছে। তারপর তার নাম হয়ে গেছে ‘লাশ’। সেই লাশ সরিয়ে নিয়ে গেছে নগর কর্তৃপক্ষের মেথররা।
ট্রাকের নিচে পড়লে পাঁজর ভাঙায় কেমন ব্যথা লাগে, সে কি তা জানতো? নইলে কি সে চিন্তা করছিলো, আমার এমন লাগছে কেন? চাকার নিচে পড়ার পর বিট্টু কী বলতে চেয়েছিলো? ওর করুণ চোখটা কেমন দেখতে হয়েছিলো? ও কি সঙ্গে সঙ্গে মরে গিয়েছিলো? তুমি জানো আঙ্গুরবালা? সে কি শেষ কয়েক মুহূর্ত বন্ধুকে দেখতে চেয়েছিলো? ‘মরে যাওয়া’ কী তা কি বিট্টু জানতো? ধীরে ধীরে যখন তার জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো, তখন কী ভাবছিলো ছোট্ট বিট্টু? বিট্টুকে কেউ কোনোদিন ক্রিসম্যাসে সাজিয়ে দেয়নি; ওর কি একবার সাজতে ইচ্ছে হয়েছিলো?
বিট্টু আর ফিরবে না কোনোদিন।