আদাচাঁই খালের ইতিবৃত্ত
মানচিত্র : আদাচাঁই খাল ও পার্শ্ববর্তী এলাকা |
আঙ্গুরবালা, তুমি তো নীল জলের ভেতর জেগে থাকা সুন্দরবনকে চেনো না। সে
সুন্দরী তার সুন্দরীর জন্য নয়, বরং সুন্দরী সে তোমার মতো সম্পূর্ণা হবার
কারণেই। তার সাথে তোমাকে মিলিয়ে দিতেই ঘটক পাখি ভাইয়ের মতো আমার চলাফেরা।
বারংবার যেন ঘুরে ঘুরে আসে চোখের আড়ালের চোখে। কল্পনার চোখে তাকে যেন তুমি
দেখে নিতে পারো, যেমন দেখি আমি তোমাকে। আমি জানি, তুমি যতো দূরেই থাকো না
কেন, দেখতে পাও আমায়। চাঁদ যেমন দেখতে পায় জলমগ্ন দিঘি।
শিবসা নদীর কথা তো তোমাকে আগেই বলেছি। তারই একটি খালের নাম আদাচাঁই।
আদার কোনো চাঁই সেখানে কোনোকালে ছিলো কি না আমি জানি না। কোনো এক চন্দ্রাহত
জেলে বা বাওয়ালির কোনো এক পূর্ণিমার রাতে খালটিকে কেন আদাচাঁই বলে মনে
হয়েছিলো, কে জানে! আদাচাঁই খালটির আরো নাম আছে। আদাসাঁই বা মানকি খাল নামেও
ডাকে বনজীবীরা। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের মধ্যে এটা।
ওহহো, তুমিতো আবার সুন্দরবনের পূর্ব-পশ্চিম বিভাগও চেনো না। খুলনা,
বাগেরহাট আর সাতক্ষীরা জেলা জুড়ে সুন্দরবন বসে আছে, তা তো জানো। বনটাকে
প্রথমে ভাগ করা হয়েছে ৫৫টা কম্পার্টমেন্টে। প্রত্যেকটা কম্পার্টমেন্টের
একটা নাম আছে। এই কম্পার্টমেন্টগুলো দেখাশোনা করে রেঞ্জ অফিস। এরকম চারটে
রেঞ্জ অফিস আছে : শরণখোলা রেঞ্জ (শরণখোলা, বাগেরহাট), চাঁদপাই রেঞ্জ (মংলা,
বাগেরহাট), নলিয়ান রেঞ্জ (দাকোপ, খুলনা) এবং বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জ
(শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)।
নলিয়ান রেঞ্জ অবশ্য খাতাকলমে খুলনা রেঞ্জ নামে
পরিচিত; তেমনি বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জও খাতাকলমে সাতক্ষীরা রেঞ্জ। রেঞ্জগুলোর
উপরে আছে বিভাগ। শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ নিয়ে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ;
আর খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ মিলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ। বিভাগের উপরে
আছে সার্কেল বন বিভাগের সুন্দরবন সার্কেল পুরো সুন্দরবন দেখাশোনা করে।
এবার এসো, আরামসে বলা যাক আদাচাঁই খালের কথা। আদাচাঁই টহল ফাঁড়িটা তো
চেনো। সেটাও চেনো না? শিবসা নদীর পাড়ে তার অবস্থান। নলিয়ান রেঞ্জ থেকে
১৬-১৭ কিমি দক্ষিণে এটা। এখনও চিনলে না? আচ্ছা, গুগল ম্যাপ দেখতে পারবে না
এতোটা আলসে তো তুমি নও! অবশ্য গুগল ম্যাপের চেয়ে গুগল আর্থে (বা ম্যাপের
স্যাটেলাইট মোডে) আরো স্পষ্ট দেখতে পাবে। খুলনা জেলার দক্ষিণে দাকোপ
উপজেলা। সেটা ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে ১৫-১৬ কিমি গেলে দেখতে পাবে নলিয়ান (বা
সুতারখালী)। নলিয়ানেই খুলনা রেঞ্জের সদর দপ্তর। এরপর দ্যাখো একটা সরু বসতি
চলে গেছে সুন্দরবনের ভেতরের দিকে। ভূখণ্ডটা দেখতে অনেকটা গরুর উচ্চপুচ্ছের
মতো, যেন লেজ উচিয়ে দৌড়োচ্ছে তিড়িং বিড়িং বাছুর। লম্বাটে সরু এই ভূখণ্ডটির
নাম কালাবগী। কালাবগীকে যেন পেচিয়ে ধরে আছে সুতারখালী নদী। নদীর ওপারে সুন্দরবন ঘিরে আছে কালাবগীর তিনপাশই।
যাকগে সেটা। তুমি নলিয়ান থেকেই সোজা শিবসা নদী ধরে নামতে থাকো। কালাবগী
থেকে শিবসা নদী কিমি পাঁচেক দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে হাঁটতে হাঁটতে কী মনে করে
যেন আবার পুবের দিকে বেঁকে গেছে। তারপর আবার ১২ কিমি’র মতো দক্ষিণপুবে চলার
পর বেখেয়ালে আবারও একটু পশ্চিমমূখো চলেছে। যেন বিকেলবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে
বিস্রস্তবেশে। যেদিক খুশি সেদিক ধাইছে। এই যে দক্ষিণ-পশ্চিমমূখো ঘুরলো, এই
মোড়টার এখানেই আদাচাঁই টহল ফাঁড়ি। নদীর পুবপাড়ে। নদীওয়ালারা বলেন, বামতীরে।
তুমি তো টহল ফাঁড়ি চেনো, নাকি? আমাদের শহরগুলোতে যেমন পুলিশের টহল ফাঁড়ি
আছে তেমনি সুন্দরবনেও বন পাহারা দেবার পুলিশদের (বনপ্রহরী) টহল ফাঁড়ি আছে।
পুরো সুন্দরবনে এরকম টহল ফাঁড়ি আছে ৭৭টি।
আদাচাঁই টহল ফাঁড়ির উত্তর-পুবদিকে প্রায় ৪ কিমি দূরে তিনটে স্রোতধারা
একসঙ্গে মিশেছে। তুমি অবশ্য বলতে পারো যে, একটা খাল থেকে তিনটে স্রোতধারা
জন্ম হয়েছ। কিন্তু চুইয়ে বা বয়ে আসা পানি বড়ো স্রোতে মিলিয়ে দেয়াই যেহেতু
খালের কাজ, সেহেতু আমি বলবো তিনটে স্রোতধারা মিলিত হয়েছে।
সেই তিনটি স্রোতধারা হলো : ছোট সাহেবের খাল, বড় সাহেবের খাল ও মানকির
ভারানি। তুমি তো ভারানিও চেনো না। একদিন চিনিয়ে দিবো। এই মিলিত স্রোতের
নামই আদাচাঁই খাল। টহল ফাঁড়িটা যে কম্পার্টমেন্টের মধ্যে তার নামও আদাচাঁই।
কম্পার্টমেন্ট নম্বর ৩৪। তো এই মিলিত স্রোত আদাচাঁই খাল নামে প্রথমে ২
কিমি উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এখানে ছোট্ট একটা নামহীন খাল এসে
মিশেছে আদাচাঁই খালে সঙ্গে। এরপর খালটা দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে আধ কিমি চলার পর
সামান্য দক্ষিণ-পুবদিকে ঘুরে গেছে। এভাবে ৫ কিমি প্রবাহিত হয়ে আদাচাঁই টহল
ফাঁড়ির পাশ দিয়ে শিবসা নদীর সঙ্গে মিশেছে। সব মিলিয়ে খালটির মোট দৈর্ঘ্য
প্রায় ৭.০ কিমি।
এখনও চিনতে পারোনি খালটিকে? তাহলে ছবিতে ৭ নম্বর খালটা দ্যাখো। চিনতে পেরেছো?