গোলপাতা মায়ের জীবন


আঙ্গুরবালা, তুমি নিশ্চয়ই আজ সারাদিন তোমার মায়ের কথা ভেবেছো। সারাদিন ধরে হাওয়া থেকে নিয়েছো তাঁর হাতের পরশ আর জীবনের বিধান, যা তিনি তোমার অনাগত দিনের জন্য তুলে রেখেছিলেন অনেক উঁচুর শিকেয়, যেন কোনো দুরন্ত বিড়ালও নাগাল না পায়। তিনি তাঁর হাত ধরে শিখিয়েছেন প্রতিটি সেরা পদ, যা নিজেকে সম্মান করার জন্য স্বীকৃতি এনে দেবে। আর তারপর ছেড়ে দিয়েছেন পৃথিবীর পথে যেখানে তুমি খুঁজে নেবে বেড়ে ওঠার জন্য সেরা জায়গা। আমার এক বন্ধু বলতেন, “মা মরে গেলে বুঝলাম মা ছিলো গাছ”। আমি আরেকটু যোগ করেই বলতাম, “আর বাবা হলো ছাতা”। তুমি এক নারী বলেই তোমাকে বলছি, কারো কারো মাতৃপ্রেম খানিকটা কসাইয়ের গবাদিপ্রেমের মতো। বলাবাহুল্য এই ‘কারো’টা হলো পুরুষ। এরা মা-কে যখন সম্মান করে তখন আসলে অভিনয় করে। অন্য নারীদের যখন দেখে তখন মাথার ভেতরে তুলনা করে বাজারের পণ্যের সাথে। রক্তীয় মাতৃসম্পর্ক ছাড়া আর কোনোভাবে নারী সম্মানিত হয় না এদের কাছে। এই আদিখ্যেতাপূর্ণ মাতৃপ্রেম দেখলে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়।


যা হোক, মনে মনে ভাবছিলাম মা যদি গাছ হয়, তবে গাছেরাও তো মা হয়! যদি হয়ই তাহলে কেমন মা তারা? ধান বা এ ধরনের ওষধি গাছের কথা ভাবো। নিজের সন্তানের জন্ম বা বেড়ে ওঠা দেখার আগেই তারা মরে যায়। ধরো কলাগাছের কথা, বীজ থেকে সন্তান জন্মানো দেখতে পায় না বটে তবে নিজের শরীরের অঙ্গ ভেদ করে জন্মানো সন্তানগুলোকে আগলে রাখতে পারে বহুকাল। খেঁজুর বা এ ধরনের গাছ, যাদের ফল খুব ছোট, তাদের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু ভাবো তো একটা নারী-তালগাছের কথা। পুরুষ তালগাছটা গুচ্ছাকৃতির কয়েকটা ফুল জন্মিয়েই খালাস। আর নারী তালগাছটাকে বয়ে বেড়াতে হয় ওইরকম ভারী তালগুলোকে, যতোক্ষণ না সেগুলো সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু শুধু মায়ের এমন কষ্ট করতে হবে কেন? প্রকৃতির এই অসম বিচার নিয়ে আমি ভেবেছি বহুবার। হয়তো প্রকৃতির একটা হিসাব আছে প্রজাতি রক্ষার, তাই মা যেমন কষ্ট ভোগ করে তেমনি সন্তানকে কাছেও পায় বেশি।


গোলপাতা গাছ অবশ্য দেখে যেতে পারে যে তার সন্তানেরা বড়ো হচ্ছে। সে উদ্দেশ্যেই এরা বাস করে দল বেঁধে, যেন একটা সমাজ গঠন করেছে সন্তান-সন্ততি নিয়ে একসাথে বসবাস করার জন্য। ধরো, একটা মা গোলপাতা, সাধারণত সে জন্মায় উরু বা হাঁটুসমান পানিতে। আর গোলপাতার, জানো তো, পাতাটা ঈগলের ডানার মতো বেড়ে উঠেছে একেবারে ভূমি থেকে। এই যৌগিক পাতাটা অবশ্য তার শাখাও। শাখা থেকে যে তিন ফুট লম্বা পাতা বের হয়, ওটাকে পত্রক বলে, তুমি পাতাও বলতে পারো। তাল প্রজাতির এই-ই একমাত্র গাছ যার কাণ্ডটা থাকে মাটির ভেতরে। লবণের কথাটা কিন্তু তুমি ভুলে যেও না। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা মোটা পাতার গোড়াটা একদম নারকেল পাতার মতো মোটা আর ফাঁপা। ওই ফাঁপা জায়গাটায় সে ধরে রাখে অধিকাংশ লবণ। এ কারণে তার শাখাটা বেশিদিন রাখতে পারে না, নারকেল, তাল আর খেঁজুরও পারে না। নোনা ভরে যাওয়া একটা শাখা খুব দ্রুতই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। পঞ্চাশ বছর বাঁচার জন্য তাই অনেকবার পাতা পাল্টানোর দরকার হয়।


গোলপাতা গাছের মা তার প্রথম প্রজন্মের সন্তানদের নিয়ে প্রথমে খানিকটা জায়গা দখল করে। কারণ সন্তানের বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিতে হবে না! সে কিন্তু ভীষণ আগ্রাসী। নদীর পাড় থেকে ক্রমশ দখল করতে থাকে তলদেশের দিকে। তারপর এক কাঁদি ফল হবে আর সেটা থেকে পাকা ও শুকনো ফলগুলো টুপ করে ঝরে পড়বে গাছটার গোড়ায়। এই ফলগুলো পাকাতে গাছটার প্রায় ৫-৬ মাস সময় লেগে যায়; মানুষের চেয়ে একটু কম। ভাসতে ভাসতে একটুখানি মাটি পেলেই শিশু গোলপাতা গাছটা বাড়তে থাকবে পানির সাথে পাল্লা দিয়ে। মা তখন লম্বা পাতা দিয়ে প্রতিরোধ করবে তীব্র বায়ুপ্রবাহ, ঝড়, সাইক্লোন। বাচ্চাটা বড়ো হয়ে উঠবে আর মৃদুমন্দ হাওয়ার সাথে দুলবে উত্তর-দক্ষিণে। তুমি তো গোলপাতা জন্মানোর মাটি সম্পর্কে জানো। কাদাময়, প্রচুর পলি ও সব সময় ভেজা থাকে এমন জায়গা হতে হবে কিন্তু। আর এরকম জায়গায় সোজা হয়ে থাকার জন্য যতোপ্রকার দড়ি-দাড়া লাগে, তার সবই আছে গোলপাতার। সেগুলো চারপাশে প্রায় বেড়া দেয়ার মতো মাটিতে শেকড় পুঁতে দিয়ে গাছটা দাঁড়িয়ে থাকে সগৌরবে, কেননা সে কোনো নেতা বা বড়ো গাছে হেলান দিয়ে বাঁচে না। বাঁচে বা মরে পুরো নিজ দায়িত্বে, ঠিক তোমার মতো।

কিন্তু সব সময় তো এমন পরিবেশ পাওয়া যাবে, তা তো নয়। কখনও কখনও জন্মায় খালের ধারে, উন্মুক্ত জলাভূমিতে। নদীর পাড়ে বা খাড়া সৈকতে হলে তো কথাই নেই, তীব্র স্রোত আর বাতাসে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় সবকিছু। সেখানে মা তার ফলগুলোকে চেষ্টা করে ভূমির দিকে রাখতে। কখনওবা ঝুলিয়ে রাখে নদীর ধারে। একদিন ফল পেকে পড়ে তীব্র স্রোতের পানিতে। ফলগুলো পেকে শুকিয়ে গেলে কিন্তু নারকেলের মতোই ছোবড়াঅলা হালকা। ভেতরে বীজটা। বীজের বইরে একটা শক্ত খোলস। তার ভেতরে শাঁস বা প্রাণের প্রাণভোমরা। যতোক্ষণ মাটি না পাচ্ছে ততক্ষণ ওই বাচ্চাটা ছোবড়ার বাইরে গলা বাড়াবে না, খু-উ-ব সতর্ক। শেকড়টাকে যদি লেজ ভাবো, তাহলে বলতে হয়, লেজটা সে ছোবড়া থেকে এট্টুসখানি বের করে দিয়ে রাখে যাতে মাটি পেলেই আঁকড়ে ধরতে পারে। তুমি যেমন মায়ের কাছ থেকে দূর দূর জায়গায় গিয়ে করে নিয়েছো নিজের ভিত, ওই ছোট্ট গোলপাতার চারাটাও তাই করে থাকে।

গোলপাতার পুরুষ ফুলের গুচ্ছটা থাকে নিচের দিকের শাখার ’পরে, আর স্ত্রী ফুল ওপরের আরেকটি শাখায়। তাই পরাগায়ন একটু কঠিন বটে। এরই মাঝে একদিন। স্ত্রী ফুলটা তখন পরাগায়ন শেষে তৈরি করেছে ছোট্ট কচি কচি ফল। এগুলোকে বলা হয় গাবনা। গোলপাতা গাছটা দেখতে পায় হাতে তীক্ষ্ণ ধারালো দা বা হেঁসো, পিটে মাটির ঠিলে আর কাঁধে বাঁক নিয়ে হেলতে দুলতে আসে একজন লোক। সে কচি ফলগুলোর ডগাটা ধরে একটু আদর করে দেয়। তারপর ধারালো দায়ের এক পোচে মাথাটা কেটে ফেলে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে কান্নার মতো রস। লোকটা ঠিলেটা বেঁধে ফেলে ফুলটার মাথার দিকে। সারারাত সেখান থেকে রস পড়তে থাকে। সকালে ঠিলে ভরে উঠলে সেটা জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় গোলের গুড়। ইন্দোনেশিয়ায় তো লোকজ চিনিও বানায়। লোকে খেয়ে বলে, “নোনতা মিষ্টি, তবে আলাদা একটা গন্ধ আছে, তাই দারুণ লাগে!”

মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মানুষ এই রস দিয়ে তৈরি করে ভিনেগার। আরো বানায় বিঅরের মতো পানীয়। কোনো কোনো দেশে আরক নামের পানীয়ও তৈরি করা হয়। কেউ কেউ ফুলের পাঁপড়ি ছিঁড়ে নিয়ে বানায় সুগন্ধী চা। মা গোলগাছটি কাঁদতে কাঁদতে নজর দেয় তার অন্য ফুলগুলোর দিকে। একসঙ্গে তিনটে বা চারটে কাঁদি জন্মায় তো। অন্যগুলো বড় করতে পারলে তবু কয়েকটি সন্তান জন্ম নিবে। কিন্তু সেখানেও মানুষেরা হামলা করে। কাঁদিসহ কচি ফলগুলো কেটে এনে দায়ের এক কোপে দু’ভাগ করে ফেলে। তারপর পায় নরম শাঁস। নোনতা মিষ্টি ও সোঁদাগন্ধের এ শাঁস বাংলাদেশের মানুষ শখ করে খেলেও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানুষের জনপ্রিয় খাবার।

ধীরে ধীরে শীত ফুরিয়ে আসে। তখনই নতুন রূপে হাজির হয় পুরোনো জল্লাদ। একখানা দা দিয়ে কেটে ফেলে লম্বা ডগা। তিরিশ ফুট লম্বা পাতার গোড়ায় দেড়-দুই ফুট রেখে কেটে নেয় সে। তারপর পাতার গোড়ার দিক দিয়ে কেটে ফেলে দেয় পানিতে। আর ১০-১৫ ফুট লম্বা অগ্রভাগ নৌকায় তুলে নিয়ে যায় ঘরের ছাউনি বা বেড়া দেবে বলে। কেউ কেউ পাতার মাঝের শিরাটা ব্যবহার করে ঝাঁটা তৈরিতে। কচি পাতাও কেটে নিতো বাঙলার রাখাইনরা, আজও নেয় ফিলিপাইনের আদিবাসীরা, বিড়ি বানাবে বলে; ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যেমন শালপাতা দিয়ে তৈরি করে। ফলগুলো দিয়ে নাকি ইদানিং বায়োফুয়েলও তৈরি করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, বায়োফুয়েলের জন্য আখ বা ভুট্টা চাষ করার চেয়ে গোলপাতা চাষ আরো লাভজনক। এক হেক্টর জমিতে আখ লাগালে পাওয়া যায় ৫-৮ হাজার লিটার বায়োডিজেল, ভুট্টায় পাওয়া যায় ২ হাজার লিটার, সেখানে গোলপাতা থেকে প্রতিবছর পাওয়া যায় সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৫ হাজার লিটার।


গোলপাতা গাছ কিন্তু মোটেই গোল নয়। বরং এর ফলগুলো যখন পূর্ণবয়স্ক হয় তখন কাঁদিটাকে প্রায় গোলাকার দেখা যায়, তাই এ নাম। ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপের অধিবাসীরা গোলপাতাকে বলে নিপা (Nypa)। ফিলিপাইনের কোনো কোনো এলাকায়ও এই নামে ডাকা হয়। সেখান থেকেই বৈজ্ঞানিক নামের প্রথমাংশ (Genus) নেয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয়াংশে প্রজাতির নাম দেয়া হয়েছে ফ্রুটিক্যানস্ (fruticans), গ্রীক ভাষায় যার মানে গুল্ম বা ঝোপ। মানে ঝোপঝাড়ের মতো দেখতে গোলপাতাই হলো নিপা ফ্রুটিক্যানস্ (Nypa fruticans)। যতোই ঝোপঝাড়ের মতো দেখতে হোক না কেন, গোলপাতার পূর্বপুরুষেরা মানুষের চেয়েও প্রাচীন। নিপা বংশের এই একজনই মাত্র এখন পৃথিবীতে টিকে আছে। কিন্তু Nypa australis নামে একটি প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়াতে। ভারতের তামিলনাড়ুতে গোলপাতার পরাগরেণু পাওয়া গেছে যার বয়স সাড়ে সাত কোটি বছর। সাড়ে সা-ত কো-টি! এছাড়া ইংল্যন্ডের কেন্টেও পাওয়া গেছে ফলের ফসিল। দক্ষিণ আমেরিকাতেও পাওয়া গেছে গোলপাতার বীজের ফসিল।

তারপরে আর কোনোদিন ইউরোপ ছাড়া কোথাও গোলপাতার বসতির সীমানা কমেনি, বরং বেড়েছে। কেননা সে নিজ সন্তান ও গোত্রের জন্য আশেপাশের বীরুৎ ও গুল্মকে মেরে এলাকা বাড়াতেও কুণ্ঠা করে না। তাই কোনো কোনো বাদাবনের ব্যবস্থাপকরা একে জায়গা দিতে চান না। কিন্তু তাতে থোড়াই কেয়ার! যদি জোয়ারে একটা বীজ পাঠাতে পারে, তারপর আর ঠেকায় কে?

বিশ্ব মা দিবসে মা হিশেবে তোমার প্রতি ভালোবাসা, আর মা গোলপাতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব। সন্তানের জন্য তোমাদের স্বার্থপরতাই সার্থক! জয়তু মা দিবস।

উদ্ভিদ : গোলপাতা, ওম গাছ
ইংরেজি নাম : Nipa Palm, Nipah Palm, Mangrove Palm, Water Coconut, Attap Palm
বৈজ্ঞানিক নাম : Nypa fruticans Wurmb (1781)
সমনাম : Cocos nypa Lour., Nipa arborescens Wurmb ex H.Wendl., Nipa fruticans (Wurmb) Thunb., Nipa litoralis Blanco, Nypa fruticans var. neameana F.M.Bailey
গোত্র : Arecaceae (তাল গোত্র)
বাদাগাছের ধরন : মূখ্য বাদা (Major Mangrove)