পান্থকথন

১৯৯৮ সাল। ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র’-খুলনার অফিস ছিলো আহসান আহমেদ রোডে। আমরা সেখানে গিয়ে বসতাম মাঝে মাঝে। তখন আমি সংগঠন বুঝতে শিখছি; হিউম্যানিটিওয়াচ নামে একটি সংগঠনের সম্পাদকগিরি করতে করতে। সাধারণত বসা-কথা হতো Boby ভাইয়ের রুমে। আড্ডাবাজি, এই দিবস পালন, ওই কর্মসূচি পালন ইত্যাদি। ববি ভাইয়ের রুমটা ছিলো সদর-দরোজা পার হয়েই বামপাশে। সেটার পাশাপাশি আরেকটা রুম। সেখানে মাঝে মাঝে আরেকজন ভদ্রলোককে দেখা যেত। শুনতাম তাঁর নাম পান্থ। তিনি নাকি চর্চাকেন্দ্রের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী। এর বেশি কিছু জানি না। আমি তখন স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্র। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কিংবা আড্ডা মারার সাহস তখনও জন্মায় নি।

২০০৩ সালে আমি যখন পিরোজপুর ছেড়ে পাকাপাকি খুলনায় এসে বসবাস শুরু করেছি তখন শুনতাম তিনি ক্রিশ্চিয়ান সার্ভিস সোসাইটি (সিএসএস) নামক প্রতিষ্ঠানের হাসপাতালের সমন্বয়কারী। তখনই একবার দেখা হলো জাতিসংঘ শিশু পার্কের বেঞ্চিতে। কিছু খুচরো আলাপ, তারপর বিদায়।

২০০৬ সাল থেকে আবার নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে। বৃহত্তর খুলনার মানবাধিকার প্রতিবেদন এবং বৃহত্তর খুলনার নারী অধিকার প্রতিবেদন তৈরি করলাম বেশ কিছুদিন খেটেখুটে। তখনই ভালো করে পরিচয় হলো Pantha ভাইয়ের সাথে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে শুরু করলো তাঁর নানা পরিচয়। এক সময়ে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সঙ্গে। খুলনার পর্বতচূড়ার মতো সুরকার সাধন সরকারের জীবন ও সুর করা গান নিয়ে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘সাধন সরকার স্মারকগ্রন্থ’। প্রথম খণ্ড পেয়েই গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম আর আমার সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করলো ষাটের দশকের খুলনা আর তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কবি আবুবকর সিদ্দিক ও হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় আমার তখনই। মাধ্যম ববি ভাই ও পান্থ ভাই।

পিতা খুলনা মহানগরীর অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠক মিজানুর রহিম। তাঁর যোগ্য পুত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত মিজানুর রহিম স্মারক বক্তৃতার তখন আমি অন্যতম কামলা। বিশেষত কম্পিউটার-সংশ্লিষ্ট কাজটুকু করতাম নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে। উত্তেজিত না হয়ে ধীর মস্তিষ্কে কী করে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সেটা শিখতে শুরু করলাম তার কাছ থেকে। সে শেখাটা আজও শেষ হয়নি। শেষ হবার জন্য হয়তো আরো বহুকাল লাগবে। কিন্তু যতোটুকু শিখেছি, সে তো তাঁর কাছেই। সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও অর্থনীতিবিদ মোঃ আনিসুর রহমানের মতো মানুষদের খুলনা শহরে এনে প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে একটি স্মারক বক্তৃতা আয়োজন এবং সেটা প্রকাশনা করা যে কতোটা ধৈর্য্য ও একাগ্রতার কাজ তা নিজে না করলে বোঝা যাবে না।

এরপর ২০০৯ সালে আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হিউম্যানিটিওয়াচ-এর চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিলেন তিনি। তখনও আমিই সম্পাদকগিরি করছি। তারপর বহু বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৬ সালেও তিনি আছেন আমার শ্রদ্ধার সেই জায়গাটিতেই। আমাদের গড়ে তোলা উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (CLEAN)-এরও চেয়ারপারসন তিনি এর শুরু থেকেই। ভাইস চেয়ারপারসন Kushal Royও রয়েছেন অপরিবর্তিত। আবারও আমিই সম্পাদক। আমাদের প্রকাশিত অধিকাংশ বইয়ের বানান, ভাষা ও লেখনিতে পাওয়া যাবে পান্থ ভাইয়ের হাতের ছাপ। এখনও প্রতিপদে তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা আমাদেরকে চলতে শেখায়। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও শেখায় লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে।

এরই মধ্যে তিনি সিএসএস-এর হাসপাতাল ছেড়ে নবলোকের প্রকল্প ব্যবস্থাপনায়, তারপর আবার ফিরে এলেন সিএসএস-এর পরিচালক হয়ে। প্রায় দুই যুগ আগে বাবার ভাষান্তরিত আফ্রিকার গল্পের বই ‘ফিরে এসো আফ্রিকা’ প্রকাশ করলেন এ বছরই যার ভূমিকা লিখে দিয়েছেন হাসান আজিজুল হক।

এগিয়ে যান পান্থ ভাই। শতায়ু হোন। আপনাকে আমাদের দরকার আরো বহু বহু বছর!