গোলাঘরে শৈশব

নাড়ায় ছাওয়া ঘরটা পুবমুখো। থাকার ঘরের ডানপাশে গোলাঘর। ওহ হো, তুমি নাড়া চেনো না, আঙ্গুরবালা? নাড়া মানে খড়, মানে ধানগাছের মূল কাণ্ডটা। শীষের অংশ, মানে যেটুকু কেটে আনা হয় কাঁচি দিয়ে, সেটুকু থেকে হয় কুটো। তবেই পুরো নামটা হবে খড়কুটো। এবার চিনেছো তো? তাইলে চুপটি করে বসো।

গোলাটার ভেতরে থাকতো শত শত চামচিকে। গোত্র-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, ময়-মুরব্বি নিয়ে তাদের বিরাট সমাজ। গোলার দেয়ালের উপরদিকে একটা ছোট মুখ থাকে, দেখেছো? ওখান থেকে মাত্র একজন মানুষ মাথা গলিয়ে ঢুকতে পারে, কোনোক্রমেই এর বেশি না। গোলা থেকে ধান বের করার আগে ওই ছোট্ট মুখটার ভেতরে একটা বাঁশ বা লগি ঢুকিয়ে জোরসে ঘোরাতে হতো। তবেই চামচিকেরা চিক চিক শব্দ তুলে ঝাকে ঝাকে বেরিয়ে যেতো গোলা থেকে। তা না হলে চামচিকে থাকা অবস্থায় যদি গোলায় ঢোকো তাহলে দু'-একটা কামড় তুমি খাবেই খাবে! সামান্য রক্ত বেরোয়, খুব একটা ব্যথাও না, তবু সুস্বাদু জিনিস না হলে তা কে খেতে চায়, বলো? তার উপর যদি প্রবাদটাও জানা থাকে, "হাতি যখন খাঁদে পড়ে, চামচিকেও লাথি মারে"।

সুতরাং, যে কেউই গোলার ভেতরে উঠতে হলে একটা লগি খুঁজতো। নিদেনপক্ষে একটা ছড় বা ছিটে। চামচিকের মল আর গা থেকে আসে ভীষণ বদগন্ধ, সেটা দূর করাও বড়োদের লক্ষ্যের ভেতরে ছিলো।

ছোটদের তো আর সে বালাই ছিলো না! চামচিকেয় কামড় দিলে শুধু সতর্ক থাকতে হবে। ব্যাপক সতর্ক যাতে মা জানতে না পারে। মা হলো আজরাইলের চেয়েও কঠিন। সুতরাং দুপুরে যখন সবাই ভাতঘুমে ব্যস্ত, ছোটদের দল তখন কাপড়ের পুতুল, নারকেলের মালা, জামরুলের পাতা, পতিত অপুষ্ট জাম, বইচি, আমজাম, মেলায় কেনা ক্ষুদ্রাকৃতির মাটির চুলো আর থালাবাসন, বড়ো দানার ধুলো আর কাঁকর নিয়ে বসে যেতো গোলাঘরের তলায়।

কারো বা একটা গরু থাকতো তেলাকচুর ফল, কেউবা গাবফুলের মুরগি পুষতো। কারো বা ছিলো মাটির রঙিন বউ বা ধুতি পরা বর, একটা ছেলে চামচিকের রাজহাঁস পুষতো। গোলাঘরের দেয়াল বেয়ে বেয়ে উঠে ছোট্ট ফুটো দিয়ে ভেতরে নামতো সে। তার উচ্চতার দ্বিগুণেরও বেশি উপরে ফুটোটার অবস্থান। সুতরাং ফিরে আসার সময় পুরোপুরি অন্ধকারে তাকে আন্দাজ করতে হতো কোথায় ধরতে হবে আর কোথায় ফেলতে হবে পা। প্রায় মুখস্থ ছিলো এইসব খুঁটিনাটি তার।

তাই বলে ভুল যে হয়নি তা কিন্তু নয়। প্রথমবার গোলাঘরে ঢুকে আর বেরোতে পারে না। ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার মধ্যে চামচিকের চিক চিক ডাক, হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো গায়ে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়া, পায়ের তলায় অপসৃয়মাণ ধানের স্তুপ, সব মিলিয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো, চিৎকার করার ক্ষমতাও নেই!

বাইরে খেলা চলছে, গোলাঘরের আরেক পাশে ডালিম গাছটার তলায়। জাগ দিয়ে গাছ থেকে পাট আলাদা করার পর পাটকাঠিগুলো ওখানে খাড়া করে রাখা থাকে। গুটি বসন্ত আর যক্ষ্মার টিকা দিতে এলে ওই পাটকাঠির জঙ্গলেই পালাতো সে।

হঠাৎ করেই কারো একজনের রঙিন বউটা পড়ে গেল আরেকজনের হাত থেকে। অমনি পুতুলঅলা বললো, "আমার মালাটুলি ফেরত দে! তোগে সাথে আর খ্যালবো না।" খেলা ভেঙে গেল, সবাই চলে গেল যার যার ঘরে। জীবন কি খেলা? মালাটুলি ফেরত নেয়ার খেলা?