সামাজিকতা এবং আমি
আঙ্গুরবালা, ভীষণ অসামাজিক মানুষ আমি। শেষ কবে বিয়েবাড়ি বা জন্মদিনের উৎসবে গেছি, মনে পড়ে না। ছোট ভাইদের মধ্যে শুধুমাত্র আসাদের বিয়েতেই হয়তো আমি বাড়িতে ছিলাম। এসব খুব গর্বের, তা নয়, বরং লজ্জারই বটে। কিন্তু কী করবো, বলো? উৎসবের ওই জমকালো আয়োজন আর নানা মানুষের পদচারণা দূর থেকেই কেবল আমার ভালো লাগে। ওই হল্লানন্দের ভেতরে নিজেকে বড্ড বেমানান বোধ হয়। তাই গা লাগে না, মনে হয়, তার চেয়ে বরং ঘুমাই আর দু' ঘণ্টা।
আমি যেসব উৎসবে আয়োজনে অংশ নিয়েছি তার প্রায় সবগুলোই অনেকটা বাধ্য হয়ে। হয়তো কোনো বন্ধুর চূড়ান্ত হুমকি, অথবা কোনো একটা দায়িত্ব চেপেছে কাঁধে। দায়িত্ব না চাপলে কখন যাই, জানো? গাঁইগুই করতে করতে একদম শেষবেলাতে হাজির হই। যেন, "দ্যাখো, আমিও ছিলাম কিন্তু!" এমন একটা ভাব দেখাতে হবে!
দায়িত্ব থাকলে আবার একদম ভিন্ন। আমার উপস্থিতি সকলের আগেই হতে হবে। পেছনে একটা যুক্তি কাজ করে : আয়োজক হিশেবে তোমার কাছে অভ্যাগতরা চায় যে তুমিই তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানাও। তোমাকে আগে না দেখলে অংশীরা হতাশ হয়ে পড়ে। তাই এই ভয় মনে জাগে, কেউ যেন অভিযোগ না করতে পারে।
আমি একটা সমাজে বসবাস করি যেটা ইউরোপীয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ না; যেটা ঢাকাভিত্তিক আত্মীয়-পরিজনহীন সমাজ না, বরং আধাগ্রাম্য মফস্বলীয় পাড়াভিত্তিক সমাজ। যেখানে সকাল হলেই পাড়ার দোকানদার আর মাল্টি মিলিওনিয়ার একই রাস্তা দিয়ে হাঁটে আর পরস্পরকে তুই সম্মোধনে ডাকে। যেখানে স্কুলের বন্ধু রিক্সাঅলা হলেও প্রকাশ্যে বন্ধু।
এটা শুধু চারপাশ না। আমার নিজের মানসগঠনও এমন, কারণ আমি ওই সংস্কৃতিতেই বড়ো হয়েছি, আর নিম্ন মধ্যবিত্তের সঙ্কটটাই হলো সে এইসব মূল্যবোধ গুরুত্ব দিয়ে মাপে। আমি তো আর তার বাইরে না!
এখানে আমরা খুব সামান্যতেই বাধ্য হই। এই বাধ্যতা কসমোপলিটন নাগরিক সংস্কৃতিতে বোঝা খুব কঠিন। এখানে সামান্য পা কেটে ক্লিনিকে গেলে ৫০ জন পাড়ার লোক ক্লিনিকে জড়ো হয়ে যায়। ওই ৫০ জনের কারোর পা কাটলে দর্শনার্থী ৫০ জনের একজন হতে হয় আমাকেও। এখানে সকলের সন্তান একত্রে খেলে। তোমার সন্তান একদিন না গেলে সেটা সমাজে আলোচিত হয়। তুমি সুপরিয়র হতে চাইলে ইনফিরিয়ররা তোমাকেই ইনফিরিয়র করে দিবে।
এগুলো ভালো কি মন্দ তা বিচার করছি না। কেননা এই যূথবদ্ধ তথাকথিত বাধ্যতা তোমাকে আমাকে বেঁধে রাখে এক সুতোয়। সংঘর্ষ ও শান্তিতে। বাধ্যতার বিরুদ্ধে তোমার যুদ্ধও আমাকে আরেক বাধ্যতায় নিয়ে যায়। আবারও ভালোমন্দ বিচার থেকে দূরে থাকি। সব জালের বাইরে সীমানার প্রান্তে যে ভালোবাসা সেটুকু নিখাদ। উপলক্ষের তোয়াক্কা না করেই।
মৃত্যুর মতো সত্য।