লঞ্চ দুর্ঘটনার দুঃস্বপ্ন
হাতিরুল এমন করেই সংবাদ দেয়। ওপার থেকে টাবুরে নাওয়ে সংবাদ এসেছে, জরুরি ভিত্তিতে যেতে হবে। এই সংবাদ কে দিয়েছে, ঘটনা কতোটা গুরুতর তার কোনো বৃত্তান্ত নেই। বাজারে খবর এসেছে দুপুরের পর, আর হাতিরুল সেই খবর যখন বাড়িতে বয়ে নিয়ে এলো তখন পশ্চিমাকাশ গাঢ় সোনালি হয়ে উঠেছে। বহুদিন আগে তার নাম ছিলো আখিরুল। বিশাল বপু, গদাইলস্করি গতি আর অপংক্তিভোজন হাতির সঙ্গেই মেলে বেশি। পিরোজপুরের তেলিখালী গ্রামে কোনোদিন হাতি না এলে কী হবে, হাতির সব বৈশিষ্ট্যই তাঁরা জানেন।
কী হতে পারে? দাদু (পিতামহী) মারা গেছেন? বড়ো কাক্কু? যক্ষ্মার রোগী নওয়া কাক্কু? নাকি চাচাতো ভাইয়ের ছেলে পানিতে পড়েছে? চাচাতো ভাই মনির কিছু করেছে? হাতিরুলের আধোবোলের সংবাদ শুনে এসব ভাবতে ভাবতে আমি বেরোলাম। নানুবাড়ির এই বনেদি বাড়ি থেকে বাজার অবধি প্রায় কুড়ি মিনিটের হাঁটাপথ। মাঝে দুটো খালের একটার ওপর পুল, অপরটা একেবারেই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। বর্ষাকালের কাদা মেখে বাঁশগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে। রাস্তার কোথাও কোথাও হাঁটুসমান কাদা, কোথাও শুকনো। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে যখন বাজারলগ্না লঞ্চঘাটে এসে পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে।
দেড় কিলোমিটারের মতো চওড়া নদীটা। ঘাটে কোনো টাবুরে নৌকো নেই। কিন্তু আমাকে এই মহানদী কচা পার হতেই হবে। লঞ্চ এলো আরো কিছুক্ষণ পর। লস্করদের কাছ থেকে জানা গেল ওপারে ঘোষেরহাটে দাঁড়াবে লঞ্চটা, তারপর ইন্দুরকানি হয়ে বলেশ্বর নদী ধরে চলে যাবে পিরোজপুরে। ঘোষেরহাট থেকে বালিপাড়া প্রায় চার কিলোমিটার। অন্ধকার রাতে ওই পথটা হেঁটেই যেতে হবে। কিন্তু আর কোনো উপায় না দেখে লঞ্চে উঠে পড়ি।
লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন যুবা তরুণ ও বয়সী। ভীষণ ভীড়। দোতলার কেবিনের দুইপাশের রেলিংগুলোও দখল হয়ে আছে নদীমুখী মানুষের অবয়বে। অাশৈশব অভ্যেসে আরো কয় তরুণের সঙ্গে আমি চলে যাই লঞ্চের পেছনদিকটায় যেখানে একটু উঁচু ছাদ আছে। আমরা ছাদের তলায় বিড়ি ধরিয়ে এলেবেলে গল্প শুরু করি। নদীতে বেশ ঢেউ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে সবাই।
এমন সময় লঞ্চ দুলে ওঠে সামনে-পেছনে। পেছনদিকটা নিচু হয়ে যেতে থাকে। মনে হয় সামনের দিকটা গানবোটের মতো উঁচু হয়ে যাচ্ছে। পিছলে পড়তে পড়তে টাল সামলে পেছন ফিরে দেখি সবাই উর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকে ছুটছে। নদীর পানি যেন ফুলে উঠছে দ্রুত। আমি সকল লোকের পেছনে যাবার কথা ভাবি। কিন্তু এই জায়গা থেকে বেরোনোর আগেই পানিতে ভরে যাবে বলে মনে হলো। হঠাৎ ছোট একটা ফাঁকা দেখা গেল। সেটা গলিয়ে নদীতে বেরোনো যাবে ভেবে বসে মাথা ঢোকাতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই সেটা পানির তলায় ডুবে গেল।
আমি ভাসছি ছোট্ট একটা কুঠুরির মধ্যে। হন্যে হয়ে খুঁজছি বেরোবার একটা, অন্তত একটা ছোট্ট পথ। কিন্তু নেই! হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেলাম ছাদের কাছাকাছি। মাথায় কি একটা আঘাত পেলাম, কী জানি! ততোক্ষণে লঞ্চের পেছনটা চলে গেছে জলের তলে। ভুস করে ভেসে উঠে হাফাচ্ছি আর ঢেউয়ের সাথে উঠছি আর নামছি। আবছা কতোগুলো মাথা দেখা যায়, কিন্তু কিচ্ছু না।
ডুবে যাবার সময় লঞ্চটার পেছন ছিলো বালিপাড়া, আমার দাদুবাড়ির দিকে। লঞ্চের কুঠুরি থেকে বেরিয়ে সেদিকেই সাঁতরাতে শুরু করলাম। সাঁতরাচ্ছি খুব ধীরে, কারণ আগেই জানতাম, তাড়াহুড়ো করলে দ্রুতই ডুবে যাবো। সলিল সমাধিতে যুক্ত হবো অন্য শতাধিক লাশের সারিতে। যদি কোনোক্রমে নদীর উত্তর পাড়টার দিকে যেতে পারি তবে সাউথখালীর চরেও উঠে যেতে পারি।
কী হতে পারে? দাদু (পিতামহী) মারা গেছেন? বড়ো কাক্কু? যক্ষ্মার রোগী নওয়া কাক্কু? নাকি চাচাতো ভাইয়ের ছেলে পানিতে পড়েছে? চাচাতো ভাই মনির কিছু করেছে? হাতিরুলের আধোবোলের সংবাদ শুনে এসব ভাবতে ভাবতে আমি বেরোলাম। নানুবাড়ির এই বনেদি বাড়ি থেকে বাজার অবধি প্রায় কুড়ি মিনিটের হাঁটাপথ। মাঝে দুটো খালের একটার ওপর পুল, অপরটা একেবারেই নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। বর্ষাকালের কাদা মেখে বাঁশগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে। রাস্তার কোথাও কোথাও হাঁটুসমান কাদা, কোথাও শুকনো। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে যখন বাজারলগ্না লঞ্চঘাটে এসে পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে।
দেড় কিলোমিটারের মতো চওড়া নদীটা। ঘাটে কোনো টাবুরে নৌকো নেই। কিন্তু আমাকে এই মহানদী কচা পার হতেই হবে। লঞ্চ এলো আরো কিছুক্ষণ পর। লস্করদের কাছ থেকে জানা গেল ওপারে ঘোষেরহাটে দাঁড়াবে লঞ্চটা, তারপর ইন্দুরকানি হয়ে বলেশ্বর নদী ধরে চলে যাবে পিরোজপুরে। ঘোষেরহাট থেকে বালিপাড়া প্রায় চার কিলোমিটার। অন্ধকার রাতে ওই পথটা হেঁটেই যেতে হবে। কিন্তু আর কোনো উপায় না দেখে লঞ্চে উঠে পড়ি।
লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন যুবা তরুণ ও বয়সী। ভীষণ ভীড়। দোতলার কেবিনের দুইপাশের রেলিংগুলোও দখল হয়ে আছে নদীমুখী মানুষের অবয়বে। অাশৈশব অভ্যেসে আরো কয় তরুণের সঙ্গে আমি চলে যাই লঞ্চের পেছনদিকটায় যেখানে একটু উঁচু ছাদ আছে। আমরা ছাদের তলায় বিড়ি ধরিয়ে এলেবেলে গল্প শুরু করি। নদীতে বেশ ঢেউ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে সবাই।
এমন সময় লঞ্চ দুলে ওঠে সামনে-পেছনে। পেছনদিকটা নিচু হয়ে যেতে থাকে। মনে হয় সামনের দিকটা গানবোটের মতো উঁচু হয়ে যাচ্ছে। পিছলে পড়তে পড়তে টাল সামলে পেছন ফিরে দেখি সবাই উর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকে ছুটছে। নদীর পানি যেন ফুলে উঠছে দ্রুত। আমি সকল লোকের পেছনে যাবার কথা ভাবি। কিন্তু এই জায়গা থেকে বেরোনোর আগেই পানিতে ভরে যাবে বলে মনে হলো। হঠাৎ ছোট একটা ফাঁকা দেখা গেল। সেটা গলিয়ে নদীতে বেরোনো যাবে ভেবে বসে মাথা ঢোকাতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই সেটা পানির তলায় ডুবে গেল।
আমি ভাসছি ছোট্ট একটা কুঠুরির মধ্যে। হন্যে হয়ে খুঁজছি বেরোবার একটা, অন্তত একটা ছোট্ট পথ। কিন্তু নেই! হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেলাম ছাদের কাছাকাছি। মাথায় কি একটা আঘাত পেলাম, কী জানি! ততোক্ষণে লঞ্চের পেছনটা চলে গেছে জলের তলে। ভুস করে ভেসে উঠে হাফাচ্ছি আর ঢেউয়ের সাথে উঠছি আর নামছি। আবছা কতোগুলো মাথা দেখা যায়, কিন্তু কিচ্ছু না।
ডুবে যাবার সময় লঞ্চটার পেছন ছিলো বালিপাড়া, আমার দাদুবাড়ির দিকে। লঞ্চের কুঠুরি থেকে বেরিয়ে সেদিকেই সাঁতরাতে শুরু করলাম। সাঁতরাচ্ছি খুব ধীরে, কারণ আগেই জানতাম, তাড়াহুড়ো করলে দ্রুতই ডুবে যাবো। সলিল সমাধিতে যুক্ত হবো অন্য শতাধিক লাশের সারিতে। যদি কোনোক্রমে নদীর উত্তর পাড়টার দিকে যেতে পারি তবে সাউথখালীর চরেও উঠে যেতে পারি।
কিন্তু ওপারে যাবো কোথায়? দুর্গম এলাকা বলে উদ্ধার করতেও আসবে না কেউ। তার চেয়ে ঘুরে তেলিখালীর দিকে গেলে উদ্ধার পাবার সম্ভাবনা আছে। ইতোমধ্যে পানি খেয়েছি খানিকটা। সুতরাং ঘুরতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। কোনদিকে নদীর পাড়, তাই-ই বুঝতে পারছি না। মনের অস্থিরতায় পা অবশ হয়ে আসছে। কখন পাড়ে পৌঁছাতে পারবো?
এমন সময় আমার সচেতন অংশ জেগে উঠলো, কেন ফিরলে আরো গভীর জলের দিকে যখন তোমার কাছেই ছিলো চরের নিশ্চিন্তি? তাতেই বাস্তব ফিরে এলো সামনে। মনে হলো, কেন দেখলাম এমন স্বপ্ন? চারপাশে তুমুল অন্ধকার, তাই? নাকি এই তুমুল ঝড়বৃষ্টির রাত বলে? জানি না, আঙ্গুরবালা। টাবুরে নৌকায় নদী পারাপারের সময় মরতে মরতে বেঁচে গেছি দু'বার। কেন তবে স্বপ্নে এলো ওই বাস্তবের অনুভূতি?
(দাদু [পিতামহী] মারা গেছেন ২০০২ সালে। আপা [মাতামহী] মারা গেছেন ২০০৬ সালে। নওয়া কাকু আর নেই ২০১৫ সাল থেকে। বড় কাকু মারা গেছেন ২০১৭ সালে। চাচাতো ভাই মনির হলো চাচাতো কাকা জিয়াউল হকের বড় পুত্র। চাচাতো ভাই জামাল হোসেনের ছেলে এখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে।)