নরসিংদী সমাচার

নরসিংদী। মানে নর-সিংহ-দিয়া। অর্থাৎ সিংহের ন্যায় (শক্তিশালী, সাহসী, হৃদয়বান) মানুষের আবাসস্থল (দিয়া)। পূর্বে নিশ্চয়ই তেমনি এক রাজা, কূলপতি, রাজন্য বা জমিদারের ভিটা ছিলো। এখন জেলা এক ঢাকার অদূরে। আমার সাথে তার সম্পর্ক শুধু কলেজের ধারে সরকারি স্কুল, তার আশেপাশে রেল কলোনি, তারই কোনো এক কোনায় একটি মস্ত বাড়ি। আমি তার ঠিঁকুজি জানি না। শুধু কল্পনার দেয়ালে ছবি এঁকে রাখি। নিশ্চয়ই কমলাপুর থেকে ট্রেন যায়, রেল কলোনিতে মাঠ থাকে, আর সেই বাড়িতে থাকে এক বিরাট পুকুর। আমার আত্মজা সেথা সাঁতরায় শামসুর রাহমানের কবিতার পংক্তি বেয়ে বেয়ে।

কুনমিং-এ নেমে মালপত্র বুঝে নিয়ে ইতিউতি চাই। আবার চেক ইন করে যদি বড়ো ব্যাগটা এয়ারলাইন কোম্পানির হাতে ধরিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে কোনো হোটেল-ফোটেল না পেলেও লম্বা চেয়ারে সটান হয়ে রাতটা কাটিয়ে দেয়া যেতো। আকুল হয়ে তাই খুঁজতে থাকি পথ বদলি যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত চেক-ইন কাউন্টারগুলো। রাত বাজে দুটো। শুনশান বিমানবন্দরে মশা আর উদ্বিগ্ন যাত্রী ছাড়া জনমুনিষ্যি নেই। দু-একজন নিরাপত্তা-কর্তা দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু চেহারার সমাজতান্ত্রিক কাঠিন্যে তাঁদের ধারে ঘেঁষা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘোরার পর চায়না ইস্টার্নের ঘুম জড়ানো কর্তা পাওয়া গেল ব্যাগ অনুসন্ধান বিভাগে। সওয়াল-জবাবে জানা গেল, কাল সকাল সাড়ে দশটার আগে ব্যাগ গছিয়ে দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই; আর তাদের একটি রাত্রিবাস-ব্যবস্থা আছে বটে, সেজন্য কয়েক পর্ব পার হয়ে যেতে হবে এবং ষাটটি মহার্ঘ মার্কিন মুদ্রা দিতে হবে।

অর্থের পরিমাণটি আমাকে অতিশয় আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলায় বিকল্প সন্ধানে ব্যপৃত হই। কয়েকজন বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক ও ছাত্রের একটা দল আমাকে সস্তায় বাংলাদেশি হোটেল পাবার ব্যাপারে প্রলুব্ধ করে তুলতে শুরু করে। এ দলটির বঙ্গীয় কিচির মিচির আগেই শুনেছি, কিন্তু বিদেশে বাঙালির বহু কেচ্ছা জেনে ওদিকে পা বাড়াই না।

এ সময় তুলনামূলক ঢ্যাঙা একটি ইউনিফর্মধারী দেখে মনে ক্ষীণ আশা জাগে। তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে সস্তায় হোটেল সংক্রান্ত খোঁজখবর চাইলে তিনি সটান বাইরের রাস্তা দেখিয়ে বলেন, 'আউত অ্যান্দ ফিফথ ফ্লোর আপ'। বলা বাহুল্য, মাওয়ের দেশে ঢোকার শুরু থেকেই গুগল মহাশয়ের ট্রান্সেলেট অ্যাপটি প্রায় সব কথোপকথনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছে।

সুতরাং 'বাহির পানে ধাই' এবং পুনরায় অতি আন্তরিক বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায়। তাঁরা জনৈক 'শরিফ ভাই'কে খুঁজছেন যিনি তাঁদেরকে কোনো এক হোটেলে নিয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে বেরিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। কুনমিং, নাকি কুমিল্লা! মনে হয় ভারতীয় সীমান্ত পার হলাম। ঢাকা হোটেল, সোনার গাঁ, মানিকগঞ্জ হোটেল নানা নামে ডাক পড়ছে। এক যুবক খুলনা হোটেল বলেও ডাক পড়লো। আরেকজন বললেন, "স্যার, আমরা নতুন হোটেল খুলেছি, আমাদেরটা একবার দেখেন।"

পুরো বাঙ্গাল বাহিনী ঢাকা হোটেলে গেল। আমারও ইচ্ছে হলো সেদিকেই যাই। কিন্তু হঠাৎ ভাবলাম, এই নতুন হোটেলেই যাওয়া যাক, কী আর হবে! এগোলাম তাঁর পিছু পিছু। রাত্রিবাসের দরদাম হয়ে গেল। অতি সস্তা। রাতের খাবার, সকালের নাস্তাসহ ২০ মার্কিন টাকা। এরই মধ্যে হোটেলে নিয়ে যাওয়া ও বিমানবন্দরে ফিরিয়ে আনার গাড়িভাড়াও যুক্ত।

রাতে আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, বেগুন ভর্তা, টম্যাটো ভর্তা, পাতলা ডাল, রুই মাছ, মুরগির মাংস ও খাসির মাংস সহযোগে সাদা ভাত খেয়ে ছিমছাম রুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম তো না, পথক্লান্তি দূর করা। সকালে ঘুম থেকে উঠে লম্বা স্নান। একদম ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা পাওয়া গেল। পরটা, ডিম আর সব্জি।

চমৎকার ব্যবহার মানুষটার। আমাদের একজন সংসদ সদস্য কুনমিং-এ একটা বাড়ি কিনে গড়ে তুলেছেন হোটেল। সেই হোটেলের ম্যানেজার তিনি। আগে আরেকটি হোটেলে একই পদে ছিলেন। ফিরতি গাড়িতে ওঠার আগে বিড়ি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী ভাই? বললেন, আনোয়ার হোসেন। বাড়ি কোথায়? 'নরসিংদী'! কলেজের উত্তরদিকে পূর্ব ব্রহ্মন্দীর কোনো এক জায়গায় এক কন্যাকে বড় করে তুলতে অনুচ্চরণীয় ভাষার দেশে একা লড়েন আনোয়ার।

শুধুমাত্র কর্মীদের ব্যবহার ও আয়োজনে আন্তরিকতার কারণে আমার বন্ধুদেরকে ওঁর হোটেলে যেতে বলবো। মাত্র এক হাজার ছ'শ টাকায় দুই বেলা খাবার ও রাত কাটানো কুনমিং বাদ দিন, বাংলাদেশেই অসম্ভব। আট ঘণ্টার স্মৃতি দারুণ! তবে ফিরে আসার সময় অ-নরসিংদী একজন আমার সঙ্গে গছিয়ে দিতে চায় প্রায় একশ’ জোড়া জুতো। তাকে ‘না’ বলতেই হলো। বেচারা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি তো আগে নিজের পিঠ বাঁচানোর পক্ষে।

ঢাকায় নেমে ব্যাগটা হাতে নিয়েই উবের বাবাজির শরণ নিলাম। পেয়েও গেলাম একটা। পাঁচ মিনিটে পৌঁছোবে। মনে মনে ফন্দি এঁটেছি, গাড়িটা কোথাও দাঁড় করিয়ে এক কাপ ঢাকাইয়া চা আর একটা বিড়ি ফুঁকে নিবো। এজন্য ড্রাইভারের সাথে একটু আগাম খাতির করে নিতে হবে। ওর নাম জহিরুল, এটা উবেরই জানিয়েছে। গাড়িতে উঠেই জিজ্ঞেস করলাম, জহিরুল ইসলাম, নাকি হক? 'ইসলাম, স্যার', ও জবাব দেয়। 'বাড়ি কই?', আমার পাল্টা প্রশ্ন। জহিরুল বলে, 'নরসিংদী!'

এবার তবে যেতেই হবে ওই ঠিকানায়! উপায় কী?