বাদাগাছের ধরন-ধারণ

আঙ্গুরবালা, সেদিন তোমার সাথে আলাপ করছিলাম ঝানা গাছটা নিয়ে। মনে আছে? ওই যে রণপার মতো পা ছড়িয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকে ঝড়ঝঞ্ঝা আর জলোচ্ছ্বাসের মাঝে। মনে পড়েছে? ওর সম্পর্কে দু-তিনটে কথা সেদিন ভুলে গেছিলাম। তুমি কি জানো, এই গাছগুলো এক নাগাড়ে ২০ দিন পর্যন্ত জলের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। এবং সেটা নোনাজল। লবণাক্ততার মাত্রা যে কতোটা তা তো তুমি আগেই জেনেছো। ইদানিং বিজ্ঞানীরা এসব গাছের বংশসার (Gene) থেকে নোনা সহ্য করার বৈশিষ্ট্যটুকু নিয়ে জুড়ে দিচ্ছেন ধান ও অন্যান্য ফসলের জাতে। তাই সেগুলো হয়ে উঠছে লবণ আর বন্যাসহিষ্ণু। এখানে একটুখানি যোগ করে নাও। বাদাগাছের মতো হাওরের করচ (Millettia pinnata) ও ছোট হিজল (Barringtonia racemosa) দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতায় টিকে থাকতে পারে। কানে কানে বলি : এ দুটো কিন্তু বাদা-সহচর (Mangrove Associate) গাছ। মানে লবণও সহ্য করতে পারে। সুতরাং ফসলের বন্যাসহিষ্ণু জাত তৈরিতে এদের বংশসার মহাজনি ভূমিকা পালন করে চলেছে।

এতক্ষণ যে গাজীর গীত গাইলাম, তা অন্য কথা বলার জন্য। আবারও কানে কানে, ‘গাজীর গীত’ও কিন্তু সুন্দরবনের বড়ে খাঁ (গাজী পীর), তার ভাই কালু ও চম্পাবতীর গল্প। বলছিলাম, তুমি তো জানো, এক সময়ে সমাজে আশরাফ আতরাফ বলে একটা ব্যাপার ছিলো। নিজেদের সঙ্গে জাত না মিললে তারা সম্মন্ধ করতো না। এখনও কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন আছে। আদিবাসীদের মধ্যেও আছে এমন, তুমি তো জানো। তারা নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে-থা করে না। তেমনি কিছু কিছু গাছ আছে যারা নিজ গোত্রের কাউকে এলাকার বাইরে যেতে দেয় না।

এরা ব্রাহ্মণ না শূদ্র সে বিচার আমরা করবো না। আদিবাসীও হতে পারে। কিন্তু গোঁড়া সাম্প্রদায়িক। এরাই মূখ্য বাদাগাছ (Major Mangrove)। বংশের কেউ একজন যদি বাদাবনের বাইরে জন্মায়, তবে সে হয়ে যাবে গৌণ বাদাগাছ (Minor Mangrove)। তুমি যদি সনাতন শাস্ত্র দিয়ে মাপো তাহলে যে বাদাবনের যে গাছগুলো ব্রহ্মবিবাহ, দৈববিবাহ, অর্শবিবাহ বা প্রজাপত্য বিবাহ করে তাঁরা নিঃসন্দেহে মূখ্যবাদা। অসুর বিবাহ, প্রতিলোম বিবাহ বা অনুলোম বিবাহ করলেই তুমি মূখ্য বাদাসমাজ থেকে বিচ্যুত হলে আর ঢুকে গেলে গৌণ বা বাদা-সহচর সমাজে।

বাস্তব উদাহরণ চাও? রোসো রোসো। তার আগে তোমাকে আরেকটা ঘটনা বলি। সেদিনকার গাছটার চেহারা মনে আছে? ও থাকে একদম নদী বা সাগরের কিনারায়। ওখানে থাকলে নিজের সংগ্রামের মধ্যেই অন্য সংগ্রামী – মাছের পোনা, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক-ঝিনুক, শৈবাল – সবাইকে অাশ্রয় দিতে হয়। যারা সংগ্রাম করে তাদেরকে তুমি কোন রং দিয়ে প্রকাশ করবে? লাল তো? ঠিক। এই বাদাগাছগুলোকে সংগ্রামের জন্য একটা স্যালুট দিয়ে ‘লালবাদা’ (Red Mangrove) বলি আমরা।

ব্যাস, নদীর পাড়েরগুলো দেখলাম। চলো, একটু ভেতরে ঢুকি। এ জায়গাটায় প্রতিদিন দু’বার জোয়ারের জল ওঠে। সাধারণত ধরো এই ছয় ইঞ্চি থেকে এক ফুট বা একটু বেশি জলে প্লাবিত হয়। জলের সাথে নানা জায়গার ময়লা, উজানের কলার খোসা, কাঁঠালের ভুঁতি, বাচ্চার জুতো, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট – সব এই পর্যন্ত ভেসে আসে। তারপর পানি নেমে গেলে থাকে পচা পাতা আর পচন-অপচনশীল সব জিনিসপত্র। পানি তো জমে থাকে না, তাহলে এ গাছগুলো আর ক্র্যাচের মতো ঠ্যাঙ দিয়ে কী করবে? তার চেয়ে বরং নোনাপানি আর এইসব ময়লা যতোদূর ওঠে তার ওপর থেকে অম্লজানটা নেয়া তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ওহ হো, আরেকটা গুরুতর সমস্যা তার আছে। ঝড় বাদলা তার গায়েও লাগে। পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে বটে, কিন্তু তার উপরিতলটা বড্ড কাদাময়। কী করা যায় বলো তো? এসো, একটা কাজ করি। খাড়া শেকড়টার চারপাশে মাটির তলায় লম্বা শেকড় ছড়িয়ে দেই ভূমিতলের সমান্তরালে। তারপর ওই শেকড়ের গা দিয়ে উপরে উঠিয়ে দিই সারি সারি শেকড়। এবার গাছের তলাটা কেমন হলো, বলো তো? একদম ভীমের শরশয্যা। শত শত সূঁচালো শেকড় মাটি থেকে আকাশমূখী হয়ে আছে। প্রত্যেকটা প্রায় একফুট বা তারও বেশি লম্বা। পুরো জায়গাটা নকশিকাঁথার মতো সেলাই করা। এবার ঝড়ের কী সাধ্যি ওকে ওপড়ায়। আর ডালগুলোও যা বেয়াড়া, ঝড়ে বেঁকে ভূমিসেজদা করবে কিন্তু ভাঙবে না, ঠিক তোমার মতো।

ওই উর্ধ্বমূখী শেকড়গুলোকে বলে শ্বাসমূল। বাদার লোকেরা বলে শুলো। মনে হয় শূলের সাথে কিছু মিল খুঁজে পেয়েছে। শুলোগুলো শুধু শ্বাস নেয় আর ঘুমায় তা কিন্তু না। অনেকগুলো শুলো মিলে এক ধরনের ছাঁকনির মতো হয়। তাতে বর্জ্য তো আটকায়ই, আরো আটকে থাকে পাতা, পাকা ফল, ফলের খোসা, মৃত প্রাণী, ডালপালা – এইসব। পানিতে ভিজে সেগুলো পচে। একে বল জৈবাবশেষ (Detritus)। অণুজীব আর ছোট প্রাণীদের ভোজ উৎসব শুরু হয় পানি সরে গেলেই। তাতে ওগুলো আরো পচে। পচে ঊর্বর মাটি হয়। এই মাটির রঙ কেমন হয়, তুমি জানো? গাঢ় ধূসর, বা সোজা বাংলায় কালো।

এবার নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছো এই ধরনের বাদাগাছকে কী বলে? একদম ঠিক বলেছো, কালোবাদা (Black Mangrove)। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ানরা ধূসর বাদাও (Grey Mangrove) বলে থাকে। এদের ফলগুলোর সঙ্গে আমের আকৃতির মিল আছে, আকারের নয়। কোনো কোনোটা একটু বড়ো হয় বটে, কিন্তু সবগুলোই মোটামুটি বকুল ফলের আকার। আমাদের সুন্দরবনে যদি খোঁজো তবে তিন ধরনের বাইন (কালা বাইন Avicennia germinans, মরিচা বাইন বা সাদা বাইন Avicennia marina ও বড়ো বাইন Avicennia officinalis) দেখলেই বুঝতে পারবে। নিচের ছবিটি এরকম একটা বাইন গাছের তলার। ছবি কিন্তু আমার তোলা না, ইন্টারনেট থেকে নিয়েছি। তোমার মতো আমিও পথে পথে ঘুরছি এখন। আস্তানায় না গেলে ছবি পাবো কোথায়?

তুমি তো জানো, বাদাবন মানেই লবণ। লবণটা এরা কীভাবে দূর করে জানো? সেটাও লালবাদা থেকে একটু আলাদা। এরা সালোক সংশ্লেষণের সময় পাতার তলা দিয়ে লবণ বের করে দেয়। তাই সিংহভাগই রয়ে যায় দেহের মধ্যে। কালোবাদা গাছের পাতার তলায় আঙুল ঘষে জিভে ছুঁয়ে দেখো, তীব্র লবণ। শিব যেমন সব গরল একা পান করে নীল হয়েছেন, এরা তেমনি লবণ খেয়ে শরীরটা ফাঁপা করে ফেলে। মরে যায় ওই রোগেই।

বাদাবন তো আসলে অনেকগুলো উপকূলীয় চর বা দ্বীপের সমষ্টি, তাও তো তোমার জানা। দ্বীপ যদি হয় তবে তার একদম মাঝখানটা সবচেয়ে উঁচু হবে। তো এই উঁচু জায়গাটায় কালেভদ্রে জল আসে। তাই পলিও আসে না। সে কারণে মাটি বেশ শক্ত। কোথাও কোথাও মাটি উষরও হয়ে যায়। এসব একেবারে সাধারণ হিসাব, তাই না? কিন্তু মাটি নোনা। মাঝে মাঝে প্লাবিতও হয়। সে কারণে লবণ দূর করতে হয়। কিন্তু তারা একটু সৌখিন। গায়েপায়ে অন্যদের তুলনায় বড়ো কিন্তু কষ্ট সহ্য করতে রাজি না। যেন হোয়াইট কলার জেন্টেলম্যান। তাইতো এদেরকে সাদাবাদা (White Mangrove) বলা হয়। এদের আর দুঃখ কী? দুঃখ ওই নোনা। নোনা তার দেহে ক্যান্সারের মতো মাংস খেয়ে ফোঁপরা করে দেয়। মেরে ফেলে গাছের ডগাও।

কিন্তু বাদাগাছ যে! স্বভাবগুণেই এদেরও শ্বাসমূল হয়। তবে তা মোটা আর খাটো। অনেকটা ক্ষুদ্র হাতুড়ির মতো। হামান-দিস্তার দিস্তাটার মতো। কিংবা বলতে পারো তোমার হাতের মুঠিপিঠার মতো। কিরপা (Lumnitzera racemosa) বা সুন্দরীর (Heritiera fomes) দিকে তাকাও, দেখবে কী সুন্দর একটা সাধারণ গাছের মতোই চারদিকে ছড়িয়ে ঘর সংসার করছে। এদের ফল চ্যাপ্টা হোক বা সরু, ভীষণ হালকা আর বীজটা ভীষণ রকম গোপন যাতে শীত, গরম বা জলে নষ্ট না হতে পারে!

আঙ্গুরবালা, তুমি বলো, আমি নাকি বংশবৃদ্ধির বিষয়টা নিয়ে খুব মজা করি। হ্যাঁ, টিকে থাকা আর সন্তানদের টিকিয়ে রাখার কৌশলটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সেদিন আহসান হাবিব ভাই বলছিলেন, উদ্ভিদ আর প্রাণীর এই আচরণগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং প্রবৃত্তিমূলক। তখন আমার মানতে ইচ্ছে করছিলো না, যদিও মানবযুক্তি তা-ই বলে। ডারউইনীয় মতে যদি প্রজাতি টিকে থাকে তাহলে তা নিশ্চিত হয় প্রজাতিটি তার সন্তানদের কোন কৌশলে নিরাপদ রাখছে, তার উপর। পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়া আর নতুন এলাকা দখল করা সেই কৌশলেরই অঙ্গ। আমি জীবজগতের এই প্রক্রিয়াটা মুগ্ধ হয়ে দেখি।

ওই বংশগতিই বাদাগাছগুলোকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। চিন্তা করে দেখ, Avicennia, Bruguiera, Ceriops, Conocarpus, Kandelia, Laguncularia, Lumnitzera, Nypa, Rhizophora ও Sonneratia – এই নয়টা বংশের (গণ, Genus) কোনো প্রজাতিই বাদাবনের বাইরে জন্মায় না। মাঝে মাঝে বিয়ে-থা করে উপপ্রজাতি বা জাত বানায় বটে তবে তাও এদের মধ্যেই হয়। এর মধ্যে Nypa’র একটা মাত্র প্রজাতি একটাই ‘গণ’। তুমি তাকে চেনো, গোল নয়, তবু গোলপাতা (Nypa fruticans) তার নাম। Conocarpus আর Lagunculariaও তাই। তুমি যদি জিজ্ঞেস করো, তোমরা কয় ভাইবোন? সাতক্ষীরা এলাকার কিশোরদের মতো সে জবাব দিবে, “অ্যাকে ভাইবুন!” তার মানে, এরা বিশ্বাস করে, জান দেবো তবু মান দেবো না।

এখান থেকে একটু বিচ্যুত হয়েছে কিছু গাছ। যেমন ধরো সুন্দরী বেগম (Heritiera fomes)। উনিও বাদাগাছ, বাংলা ভারতে ব্যাপক যেমন সম্মান তেমনি দাম। বেশ সৌখিন তিনি। সাদাবাদা’র মধ্যে পড়েন। ওনার বংশের (Genus) নাম Heritiera। মোট আঠারো সন্তান (species)। সাতজন শুধুমাত্র বাদাবনে জন্মান। বাকি এগারোজন উপকূলীয় নোনাপানিতে জন্মান। গেল জাত মারা! বাদাবনে জন্মাবেন সবাই, তা না; কয়েকজন আবার উপকূলে ঢং করতে গেলেন। ব্যাস, উনি পড়ে গেলেন গৌণবাদার দলে। গেওয়া (Excoecaria agallocha) ভাইজানেরও একই অবস্থা।

এবার এসো গড়শিঙ্গা (বা গড় শিঙ্গিয়া) মশায়ের কথা বলি। ওনারা ‘দশে ভাইবুন’। এঁদের মাত্র তিনজন উপকূলে জন্মান। বাকি সবাই স্বাদুপানিতেই ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারেন। আর শুধুমাত্র ইনিই, যাঁর বৈজ্ঞানিক নাম Dolichandrone spathacea, প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতে পারেন বাদাবনের ভেতরে। সুতরাং বাদাগাছের মধ্যে এঁর মর্যাদা সবথেকে কম, প্রায় চাকর-বাকরের মতো। এঁদেরকে ডাকা হয় বাদা সহচর। তোমার প্রিয় আকন্দ (Calotropis gigantea),  কাঠবাদাম (Terminalia catappa), কুটুমকাঁটা (Caesalpinia crista), কুঁচ (Abrus precatorius), কেয়া (Pandanus tectorius), কেয়াকাঁটা (Pandanus foetidus), ডাগুর (Cerbera manghas), নলখাগড়া (Phragmites karka) আর পরশপিপুলও (Thespesia populnea) কিন্তু বাদা-সহচরের দলে পড়েছে।

এর বাইরে আরো শত শত গাছ একটু ঊর্বর জমি আর অালো বাতাস পেয়ে বাস করতে আসে বাদাবনের মাটিতে। শুধু আমাদের সুন্দরবনেই আছে এমন ৪৩৪ প্রজাতির গাছপালা। দিনশেষে ওদেরকে ডাকা হয় ইনভাসিভ স্পিসিজ, এলিয়েন স্পিসিজ বা এক্সোটিক স্পিসিজ। ওরা একটু সুখের জন্য বা দায়ে পড়ে আসে এই ভূমিতে। ওদেরকে তুমি পুঁছবে কেন, আঙ্গুরবালা?

বরং সোজা হয়ে দাঁড়াও। বলো, “আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে?”