কেওড়ার কীর্তিকলাপ


Sonneratia apetala

তুমি কি কোনোদিন কেওড়া ফল খেয়েছো, আঙ্গুরবালা? আবার ব’লো না যে, “কত্তো খেয়েছি! আমাদের বাজার থেকে কিনে এনে খেয়েছি। খোসা ছাড়ানো দারুণ দারুণ কেওড়া ফলের শাঁস পাওয়া যায় বাজারে!” কেওড়া ফল আবার খোসা ছাড়ানো? খোসার ভেতরে শাঁস? সেই ব্রিটিশদের চা খাওয়া গল্পের মতো হয়ে গেল না?

ব্রিটিশদের প্রথম দল নাকি চীনে এসে চা খেয়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। তক্ষুণি ওই দলের মধ্যে একজনের ব্রিটিশ বেনিয়া বুদ্ধি জেগে উঠলো। সে দুই জাহাজ চা বোঝাই করলো। দুটো জাহাজকেই আদেশ দিয়ে দিলো, ব্রিটেনে চা নামিয়েই বাজারজাত করে ফেলতে হবে যাতে টাকা নিয়ে দ্রুত ফিরে এসে আবার জাহাজ বোঝাই করে পাঠানো যায়। চীনা এক মহিলার কাছ থেকে উত্তম চা প্রস্তুত প্রণালী লিখে সে নিজে একটি জাহাজে উঠে পড়লো। দুর্ভাগ্যবশত বেনিয়ার জাহাজ পিছনে পড়ে গেল। আগের জাহাজ পৌঁছানোমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর চা নামিয়ে বাজারে বিক্রি শুরু করে দিলো। ফিশ অ্যান্ড চিপস্-এ বিরক্ত ব্রিটিশরা নতুন খাদ্য পেয়ে ব্যাপকহারে কিনতে লাগলো। দ্বিতীয় জাহাজে বেনিয়া পৌঁছে দেখলেন প্রথম জাহাজের সব পণ্য শেষ। লোকে চায়ের জন্য মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে। তখনই তার সন্দেহ হলো। রেসিপি রয়েছে তাঁর কাছে। লোকে তবে এই নতুন পানীয় কী পদ্ধতিতে  সে একজন ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, চা কীভাবে প্রস্তুত করছেন? লোকটি গর্বের সঙ্গে বললেন, একদম মুঘল কেতায়! সেটা কেমন? এবার লোকটি জানালো, প্রথমে চায়ের পাতাগুলো সিদ্ধ করে পানিটা ফেলে দিয়ে ঘন দুধ আর চিনি মাখিয়ে খাচ্ছি। দারুণ স্বাদ!

সুন্দরবন সম্পর্কে উষরাঞ্চলের মানুষের ধারণাও এমন। তাঁদেরই কয়েকজন গবেষক একবার এই অধমের সঙ্গে সুন্দরবন-সংলগ্ন গ্রাম কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী গিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণার কাজে। সেখান থেকে বিকেলে ফেরার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, সকালে যাবার সময় দেখলাম নদীতে ভরা পানি। এখন দেখছি পানি একদম তলায় চলে গেছে। এত পানি গেল কোথায়? তখন তাকে বলতে হলো, জোয়ারের সময় সাগর থেকে পানি আসে। তখন এখানকার নদীগুলো একেবারে কানায় কানায় ভরে যায়। দু’পারে বেড়িবাঁধ আছে বলে রক্ষে। তা না হলে গ্রামগুলো ভেসে যেতো। কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধের ছিদ্র বা ভাঙা জায়গা দিয়ে পানি ঢুকে গ্রামের নয়ানজুলি, খানাখন্দ আর নালাগুলোও ভরে তোলে। কিন্তু এক সুন্দরী তরুণী তখনও বুঝতে পারছেন না, জল এত ঘোলা কেন। তাঁরা তখনও জানেন-ই-না যে প্রতিবছর এখানকার নদীগুলো বহন করে প্রায় সোয়া এক কোটি টন পলি।

একটা ঘটনা শোনো। গত বছরই তোমার জন্য কিছু কেওড়ার ফল এনে শুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম, কেওড়া শেষ হয়ে গেছে। এ বছর যেই এক বয়োকণিষ্ঠকে বললাম, কেওড়া লাগবে। ও বললো, “ভাই, কেওড়া কোনো সমস্যা না। আমাদের বাড়িতিও চাইরডে গাছে হইয়েছে”। আমি তো অবাক! ওদের বাড়িতে আমি অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু বড় কেওড়া গাছ তো দেখিনি! হঠাৎ কেওড়া গাছ এলো কোত্থেকে? জিজ্ঞেস করতেই জানালো, “আইলায় পুরো কয়রা এলাকা ভেসে গিছিলো, সে তো জানেন।”
- “জানবো না আবার! দু’বছর আন্দোলন করলাম না আমরা ওই বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণের জন্য?” আমার উত্তর।
- “ওই তো। সে কতা এহনও গ্রামের লোকে কয়। আপনারে দেখতি চায় রিয়াসাত ভাইরা। ওই সময় গ্রামের সব বাড়িতি কেওড়া, গেউও আর সুন্দরীর চারা হইছিলো। এ বছর কেওড়ার ফল হইয়েছ্। অনেক অনেক ফল। ফলের জন্যি গাছ দেহা যাচ্ছে না। গ্রামের লোকজন খেয়ে পাইত্তেছ না।”
- “তাহলে আমাকে কিছু ভালো মানের কেওড়া পাঠিয়ে দিও। আর গোলফল জোগাড় করে দিতে পারবে?”
- “পারবো, ভাই। গোলফল এখনও বড়ো হয়নি। একটু বড়ো হলে কেওড়ার ফল আর গোলফল পাঠিয়ে দিবানি।

বুঝলে তো, আঙ্গুরবালা, আইলার সময় জোয়ারে পানি গ্রামে ঢুকেছে। সঙ্গে ঢুকেছে কেওড়ার পাকা ফল। নিচু জমিতে একটু পলিকাদা পেয়েছে, অমনি কেওড়ার চারা লকলক করে বেড়ে উঠেছে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এই গ্রামগুলোতে। আমাদের দেশে বা সুন্দরবনে কেওড়া নদীর পাড়ে নাবালো জায়গায় বা চরের উপর ব্যাপকহারে জন্মায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের নদীর পাড়ে জন্মানোর কথা না। যেখানে সরাসরি ঢেউয়ের আঘাত লাগে না, একটু কাদা আছে এমন জায়গাতেই কেওড়া গাছ বাস করতে স্বস্তিবোধ করে। কেননা এদের ঠেসমূল নেই, বরং আছে শ্বাসমূল বা শুলো। তোমাকে তো আগেই বলেছি, কাদার দুনিয়া যেখানে প্রতিদিন জোয়ারের পানি উঠে বনভূমি ধুয়ে নিয়ে যায় সেখানে কিছু বাদাপ্রজাতি জন্মায়। এগুলোকে ‘কালোবাদা’ (Black Mangrove) বলা হয়। কারণ পাতা পচা কালো মাটিতে এরা বড়োই শান্তি পায়।

ফলের গঠনের জন্য কেওড়া বংশের যতো ভাইবোন আছে সবাইকেই ইংরেজিতে ম্যানগ্রোভ অ্যাপল (বাদা আপেল?) বলা হয়। একটার সাথে আরেকটার পার্থক্য নির্ধারণের জন্য হয়তো একটু এদিক-ওদিক করে দেয়া হয়। যেমন একটাকে বলা হলো White-flowered Apple Mangrove, অন্যটাকে বললো Red-flowered Apple Mangrove। আবার অন্য একটাকে যদি বলছে Lanceolate-leafed Apple Mangrove, তো আরেকটাকে বলছে Ovate-leafed Apple Mangrove। এছাড়া আর উপায়ই বা কী? ইংরেজি-ভাষাশাসিত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ছাড়া তো আর কোথায় এরা নেই! সুতরাং যেভাবে হোক গোঁজামিল দিয়ে একটা ইংরেজি নাম দিয়ে দেয়া। ওই যে, একটা গল্প আছে না মুহাম্মদ জাফর ইকবালের? ক্লাসে হাজির হবার পরে নবাগত ছাত্রকে শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন, তোর নাম কী? ছাত্র বলে, আমার নাম বল্টু। শিক্ষক রেগে গিয়ে বলেন, ভালো নাম কী? ও নিরীহভাবে বলে, ভালো নাম নাই। কেন নাই? শিক্ষক রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ছাত্র উত্তর দেয়, আব্বার ভালো নাম দেবার টাইম নাই! অনেকটা সেরকমই।

কেওড়ার ইংরেজি নাম : Sonneratia Mangrove, White-flowered Apple Mangrove।  অন্যান্য নামগুলো হলো :  Wu Ban Hai Sang (Chinese), Chipi (Marathi), Kandal (Marathi), Keruan (Oriya), Khirwa (Oriya), Kirala (Sinhalese), Marama Maram (Tamil), Kalingi (Telegu), Kyalanki (Telegu)। আর কোনো দেশের নাম নেই, কারণ আর কোনো দেশে কেওড়াই নেই। ও, বলতে ভুলে গেছি, অনেক কষ্ট করেও বার্মিজ নামটা খুঁজে পেলাম না। বার্মার বন্ধুদের তড়িৎডাক পাঠিয়ে দিয়েছি, ওরা উত্তর দিলে তোমাকে অবশ্যই জানিয়ে দিবো। ওসব নাম-ফাম বাদ দিয়ে যদি তুমি একবার সুন্দরবনের কোকিলমণি কিংবা কটকা অভয়ারণ্যের দিকে যাও তাহলে দেখতে পাবে কেওড়ার সৌন্দর্য্য কাকে বলে! মাইলের পর মাইল জায়গায় নদীর চরে হাজার হাজার কেওড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। কিন্তু কোন মালি যেন নিয়মিত গোড়ার দিকের পাতা ছেঁটে সাজিয়ে রেখেছে যেন চর্চিত বাগানের মস্ত থুজা গাছ। গাছের গোড়ার দিক দিয়ে তাকালে বনের ভেতর পর্যন্ত দেখা যায় অনায়াসে। কিন্তু ওপরে তাকালে শুধু পাতা আর ঘন জঙ্গল। কে কেটেছে জানো? চিতল হরিণেরা। ওরা ঝাকে ঝাকে এসে কেওড়ার পাতা খায়। সর্বোচ্চ যে পাতাটার নাগাল পায় সেটা খেয়ে ফেলে। ফলে সবগুলো গাছের পাতা সমান নিচের দিকে সমান করে কাটা। একদম মেপে মেপে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য!

বাদাবনের অন্যদের দেয়ার জন্য এদের আছে প্রভূত সম্পদ। বানর ছাড়াও নানান রকম পাখি কেওড়ার ফল খায়। কেওড়া পাতা খায় চিত্রল হরিণেরা। তবে হরিণ যে সারাক্ষণ কেওড়ার পাতা খেয়েই বাঁচে তা কিন্তু নয়। তৃণভূমিগুলোতে হরিণ ঘাস, ছন, নলখাগড়ার পাতা, হেঁতালের পাতাও খায়। গেওয়া (Excoecaria agallocha), বাটিয়া (Shirakiopsis indica) ও ডাগুর (Cerbera odollam) বাদে প্রায় সব পাতাই খেতে পারে। আর মানুষ তো কেওড়ার ফল খায়ই। পারলে গাছটাই কেটে নিয়ে যায়। কেননা কেওড়ার  বাদাগাছের মধ্যে এই কেওড়া আর ওড়া একটু ব্যতিক্রম। অন্য গাছগুলো বংশবৃদ্ধির জন্য যার যার আখের সে সে গুছিয়ে নিলেও কেওড়া একটু-আধটু অন্যের উপর নির্ভরশীল বলেই মনে হয়। পাখি বা প্রাণীর ভক্ষণের মধ্য দিয়েই বীজ ছড়ায় মায়ের আঁচলের তলা থেকে দূরের কোনো গাঁয়। কিন্তু পুরোপুরি তাও নয়। কেওড়ার ফলগুলো খাবারযোগ্য হলে কী হবে? ওগুলো ভীষণ হালকা, তাই পানিতে ভাসতে পারে। আর ভেসে ভেসে যদি একবার পায়ের তলায় জমিন পায়, তাহলে আর ঠেকায় কে! আর বীজও হয় মাশাল্লাহ, এক একটা ফলে শ’খানেক বীজ। একটা না একটা তো ফুটবেই!

কেওড়ার আপন ভাইবোনের মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া যায় ওড়া (Sonneratia caseolaris)। এছাড়া ভারতে, মিয়ানমারে (বার্মা) আর চীনেও পাওয়া যায়। চীনে কিন্তু কেওড়া স্বাভাবিকভাবে জন্মায়নি। অর্থাৎ ওরা ওদেশের জন্মসূত্রে নাগরিক না। ইংরেজিতে যাকে বলে ন্যাচারালাইজড্, সেভাবে ওরা চীনের বাসিন্দা হয়েছে। এ নিয়ে চীনা বাদাবন সংরক্ষণকর্মীদের সে কী রাগারাগি! ২০১৫ সালে চীনা বাদাবন সংরক্ষণ নেটওয়ার্কের যে দলটা এসেছিলো আমাদের সুন্দরবনে ঘুরতে, ওরা আমাকে সব ঘটনা বললো। চীন সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে বাদাবন সংরক্ষণের একটা চুক্তি করে। সেই চুক্তির আওতায় আমাদের দেশ থেকে মরিচা বাইন (Avicennia marina) ও কেওড়ার বীজ নিয়ে ওদের বাদাবনে লাগায়। চীনের উপকূলে যেসব বাদাগাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় সেগুলো খুব ধীরে ধীরে বাড়ে, আর জন্মগতভাবে বেঁটেও বটে। সেখানে কেওড়া আর বাইন বাড়ে সাঁইসাঁই করে। ফলে ওই গাছগুলো এদের ছায়ায় পড়ে আর বাড়তে পারে না। শেষে জোয়ারের নোনাপানিতে ডুবে মরে। এটা তো ওখানকার প্রতিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর, না?

তুমি কি জানো, কোনো কোনো দেশে ওড়াফলের শরবত খুব জনপ্রিয়? ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া ও ভিয়েতনামে এই শরবত ব্যাপক পান করা হয়। ওসব দেশের আদিবাসীরা বাইনের ফলও রেঁধে খায়। আমাদের দেশে অবশ্য সে চর্চা নেই। কেওড়া দিয়েও একইরকম শরবত বানানো যায়। বানাবে? খুব সহজ। পাকা কেওড়ার ছালটা ছাড়িয়ে নাও। এটা ছাড়ানো অবশ্য একটু কঠিন। কেওড়া ফলটা এমনিতে মার্বেলের চেয়ে একটু বড়ো। উপরে পুরু একটা ছাল, ভেতরে শ’খানেক বিচি। ছুরি দিয়ে সাবধানে না ছাড়ালে বিচি কেটে চলে আসতে পারে। আরেকটা পদ্ধতি অবশ্য আছে। পাকা কেওড়াটা পরিস্কার পানিতে আধঘণ্টা ভিজিয়ে রাখো। তারপর একটা বাঁশের তৈরি চালুনিতে ফেলে ঘষা দাও। ছালটা পেস্টের মতো হয়ে চালুনির ফাঁক দিয় নিচে রাখা পাত্রে পড়বে। ওহ হো, কেওড়ার কিন্তু খোসা বা ছালটাই শাঁস। ভেতরে শুধু বিচি।

এবার শাঁসটা ব্লেন্ডারে ঢোকাও, সঙ্গে মেশাও চিনি আর প্রয়োজনমতো লেটুস পাতা। ব্লেন্ডারে ঘুঁটে নিয়ে গ্লাসে ঢালো। তোমার যদি ব্লেন্ডার না থাকে তাহলে হামান-দিস্তায় বা বাটিতে ফেলে পেস্ট করে নিতে পারো। প্রয়োজনমতো চিনি বাড়িয়ে বা কমিয়ে আরো কয়েক টুকরো লেটুসপাতা ছড়িয়ে দিয়ে পরিবেশন করো। ব্যাস, হয়ে গেল কেওড়ার শরবৎ! চাইলে একটু বিট লবণ বা লেবু তোমার ইচ্ছেমতো যোগ করতে পারো। এভাবে তুমি বানাতে পারো কেওড়ার ককটেলও। ককটেল বানাবার সময় যোগ করবে সামান্য ঠাণ্ডা পানীয়। হয়ে গেল!

কেন ওড়াফলের শরবত হয় ওসব দেশে? কারণ ওখানে কেওড়া জন্মায় না। ওদের দেশে যেসব প্রজাতি পাওয়া যায় সেগুলো হলো Sonneratia alba, ওড়া (Sonneratia caseolaris) ও Sonneratia ovata। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় নরম্যান ডিউক ও জ্যাকস্ নামে দুই বাদাবন-বিশেষজ্ঞ Sonneratia × gulngai নামে একটা সঙ্করজাত খুঁজে পেয়েছেন। এছাড়া চীনের দক্ষিণে হাইনান দ্বীপে আরেকটি সঙ্কর জাত খুঁজে পাওয়া গেছে। এটার নাম Sonneratia × hainanensis। আমাদের দেশে তো কেওড়া (কেরফা) আর ওড়া (ছইলা) শুধু হয়, জানো তো? আমাদের কাছের শ্রীলঙ্কাতেও তুমি কেওড়া পাবে না। সোনেরাশিয়া অ্যালবা বলে ওখানে একটা প্রজাতি পাওয়া যায়। ওটার ফল ওড়ার মতোই বড়ো তবে কিছুটা গোলাকার, অন্তত ওড়ার চেয়ে গোলাকার।

তুমি তো কেওড়ার জল চেনো, না? এক সময় আমিও মনে করতাম কেওড়ার ফুল বা ফলের একরকম কারিকুরি করে এরকম রস বের করা হয়। কিন্তু ফুল বা ফলের সঙ্গে ঘ্রাণের কোনো মিল নেই কেন? সে এক বিরাট রহস্য বলে মনে হতো। পরে জানলাম, কেওড়ার জল হয় কেয়া বা কেতকী (Pandanus) ফলের নির্যাস থেকে। কেয়ার দুটো প্রজাতি পাওয়া যায় আমাদের দেশে, একটা কেয়াকাঁটা বা কাইকি কাঁটা (Pandanus foetidus) আরেকটা কেয়া বা কেতকী (Pandanus tectorius)। আবার ধন্দে পড়ে গেলাম। কেয়া ফল থেকেই যদি হবে তবে তাকে কেওড়া জল বলা কেন? মনে হলো এ নাম বুঝি কোলকাতার কোনো ইংরেজ সাহেবদের বাবু বা মুন্সি দিয়েছেন। হয়তো ভেবেছেন সুন্দরবন থেকে যেহেতু এসেছে কেওড়ার জলই হবে। অবশেষে আসল গোমর ফাঁস হয়েছে। হিন্দিতে কেতকীকে বলা হয় কেওড়া। তার নির্যাসের নামই কেওড়ার জল। এবার বুঝলাম, কেন মানুষ চীনা বাদামকে চীন দেশের বাদাম মনে করে!

কিন্তু প্রায়শই দুটোর পার্থক্য বের করতে গিয়ে ধন্দ লাগে! দু-তিনটে পার্থক্যের কথা তোমায় জানিয়ে দেই : প্রথম পার্থক্য তো অবশ্যই ফল। কেওড়ার ফলটা খুব ছোট, এই ধরো মার্বেলের থেকে একটু বড়ো। আর ওড়ার ফল প্রায় আপেলের আকারের। লাল এক ধরনের আপেল পাওয়া যায় না, চ্যাপ্টা, সুন্দর স্বাদ, ওই আপেলটা বা ওর থেকে একটু বেশি চ্যাপ্টা হয় ওড়ার ফল। একটু চ্যাপ্টা কমলালেবু হলে যেমন দেখাতো তেমন। গায়ের রঙটা কিন্তু সবুজ বা সবজেটে লাল। ওড়ার গাছটা হয় ছোট এবং একটু বাঁকা, কিন্তু কেওড়া গাছ মোটামুটি সোজা এবং লম্বা। ধরো ওড়া যদি সর্বোচ্চ ৪০ ফুট লম্বা হয়, তাহলে কেওড়া লম্বা হবে ৬০ ফুট। একই অনুপাতে কেওড়ার শ্বাসমূলও বেশ বড়ো। ধরো, গড়ে দুই থেকে সাড়ে চার ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এক একটা শুলো। সেখানে ওড়ার শ্বাসমূল এক ফুট থেকে আড়াই ফুট অবধি লম্বা। ফলের মতোই ওড়ার ফুল বড়ো, কেওড়ার ছোট। এবারও চিনতে পারলে না? ফুলটা আরেকবার দেখ। কেওড়ার পুংকেশরগুলো সবজেটে সাদা, আর ওড়ার পুংকেশর গোলাপি লাল। ফুলের আরো পার্থক্য চাও? কেওড়ার বৃত্যাংশ চারটি, ওড়ার পাঁচ থেকে আটটি। যখন ফল হবে তখনও এই বৃত্যাংশগুলো ফলের বোঁটার সঙ্গে থাকবে। এবার গাছটার দিকে আরেকটু ভালো করে তাকাও। কেওড়া গাছ বড়ো হলে তার বাকলে ফাটল হয়, কিন্তু ওড়ার ক্ষেত্রে তা হয় না। একটু অমসৃণ দেখায় বটে কিন্তু ওড়াগাছের গায়ে কোনো ফাটল থাকবে না। এখন? চিনতে পারছো না? এবার তবে শেষ পার্থক্যটা। কেওড়া গাছের গায়ের রঙ হালকা থেকে গাঢ় বাদামি। আর ওড়াগাছের গায়ের রঙ ধূসর থেকে গাঢ় বাদামি। ওহ হো, পাতাটাও দেখে নিতে পারো। কেওড়ার পাতা লম্বাটে, কিন্তু ওড়ার পাতা উপবৃত্তাকার। এবার চিনবে তো?

যদি চিনে থাকো তাহলে কয়েকটা কেওড়া ফল তুলে আনো। ভালো টক রেঁধে খাওয়া যাবে। সুন্দরবন-সংলগ্ন নোনা মানুষেরা এ ধরনের টক রান্নাকে বলে খাটা। কোনো কোনো এলাকায় খাট্টাও বলে। খাট্টা শব্দটা হিন্দি। এর অর্থ টক। দক্ষিণাঞ্চল এক আজব দুনিয়া। আমড়ার খাটা, আমের খাটা, তেঁতুলের খাটা, এমনকি আনারসেরও খাটা রেঁধে খায়। যে কোনো মাছ, মায় মাংসের খাট্টাও রাঁধে তারা। অমৃত তার স্বাদ। কী করে রাঁধবে? বোকা মেয়ে, এটুকুও জানো না! পাকা কেওড়ার শাঁসটা ছাড়িয়ে নাও। তারপর ওটা বেটে বা গ্রাইন্ডারে দিয়ে পেস্ট করে নাও। পেস্টটা পানিতে গুলে প্রয়োজনমতো চিংড়ি দিয়ে ঝোল রেঁধে ফেল। কেউ কেউ কিন্তু কেওড়া সিদ্ধ করে শাঁস বের করে। নিতান্ত বাধ্য না হলে ওটা করবে না। কাঁচা ফলের ক্ষেত্রে সামান্য সিদ্ধ করে নিতে পারো। সিদ্ধ করলে অবশ্য সুগন্ধটা যেমন চলে যায়, তেমনি চলে যায় কিছু খাদ্যগুণও। ওহ, পিঁয়াজ, রসুন, লবণ আর একটু হলুদ দিতো ভুলো না যেন। চিংড়ি কতোরকম পাওয়া যায় জানো? চাকা চিংড়ি, হরিণা চিংড়ি, ঘুঁষা চিংড়ি, কাঠালি চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, গোদা চিংড়ি - এমন হরেক রকম চিংড়ি হয় সুন্দরবনের নদী-খালে। এর মধ্যে খাটা সবথেকে ভালো হয় চাকা চিংড়ি দিয়ে। সে স্বাদ অমৃত। পাতলা মুসুরি ডালের সঙ্গেও মিশিয়ে দিতে পারো কেওড়ার খোসা। দারুণ টক-ডাল হবে।

আমাদের ছোটবেলায় খালের পানিতে ভেসে ভেসে আসতো কেওড়া আর ওড়ার পাকা ফল। সবগুলো যে খাবার যোগ্য থাকতো তা নয়। স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোনো কোনোটার খোসা পচে উঠতো। আর চ্যাংড়া ঝুতপালা খালের পাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়তো স্রোতের মধ্যে কেওড়া ফলের সাথে সাথে ভেসে যেতো বহুদূর। কয়েকটা ফল ধরে এনে ভাগাভাগি করে খাওয়া হতো। বড়োরা গাছ থেকে পেড়ে আনতেন ধামা ভরে। ধামা ভরে আনা ওই কেওড়ার শাঁস ছাড়িয়ে রোদে শুকানো হয়। শুকিয়ে তৈরি হয় আমচুরের মতো শুকনো কেওড়া। তারপর একেবারে আমের আচারের মতোই তৈরি করা হয় কেওড়ার আচার। কেউ কেউ চাটনিও তৈরি করেন। গ্রামের গরিব মানুষেরা কেওড়ার ফল ছিঁড়ে এনে বিক্রি করেন মফস্বলের হাটে। সেখান থেকে আধা-শহুরে ভদ্রলোকেরা কিনে এনে বাড়িতে রান্না করে খান বা তৈরি করেন নিজেদের বাড়ির আচার।

কেওড়ার মধুও কিন্তু খুব ভালো। আমাদের ছোটবেলার আরেকটা সুস্বাদু খাবার ছিলো বাড়িতে তৈরি করা মধু। সেটা আরেকটা মজার খেলা। কেওড়া বা ওড়ার ফুলটা দেখতে কিন্তু খানিকটা জামরুলের ফুলের মতো। অসংখ্য পুংকেশরে সাজানো তার সদর দরোজা। অপূর্ব সে রূপ। সেসব অগ্রাহ্য করে কয়েকটা ফুটন্ত ফুল ছিঁড়ে নিয়ে এসো। পুংকেশরগুলো গোছা গোছা তুলে ফেলে দাও। তারপর একটা থালায় পোয়াইঞ্চি উচ্চতা হয় এমনভাবে পানি দাও। এবার কেওড়া ফুলটা এমনভাবে রাখো যেন গর্ভদণ্ডটা উপরের দিকে থাকে। এভাবে ঘণ্টাখানেক রেখে দাও। দেখতে পাবে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়েছে। প্রত্যেকটা ফুলের ভেতরদিকে খানিকটা করে পানি জমেছে। পানিটুকু একটু ঘন। ফুলের নিচের পানির চাপে ঘন মধুটা জমা হয়েছে ভেতরের অংশে। এবার একটা বাটি এনে ফুলের ভেতরের পানিটা বাটিতে জমা করো। তারপর এক চুমুকে সাবাড় করে দাও। অপূর্ব স্বাদ না?

সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছের মতোই কেওড়ার কাঠ কিন্তু ততোটা মূল্যবান নয়। নরম ও আঁশবহুল কাঠ হওয়ায় এ গাছ দিয়ে ভালো আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না। কিন্তু প্যাকিং বক্স, ছোটখাটো সাময়িক কাঠামো কিংবা জলাভূমির মধ্যে খুঁটি হিশেবে ব্যবহার করার জন্য ভালো। তাই বসতির ধারের গাছগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মানুষ। আবার নদী শুকিয়ে যাবার কারণেই ক্রমশ মরে যাচ্ছে উজানের গাছগুলো। গত বছর দশেক আগেও খুলনা থেকে সাতক্ষীরা যাবার পথে পাটকেলঘাটায় কপোতাক্ষ নদের সেতুর বামপাড়ে একটা ছোটখাটো কেওড়া বন ছিলো। গাড়িতে করে যাবার সময় গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বর্ষিয়ান কেওড়াসমাজটা দেখে খুব ভালো লাগতো। ধীরে ধীরে সেগুলো শুকিয়ে যেতে যেতে এখন আর একটিও নেই। খুলনা শহরের দক্ষিণ প্রান্তে এখনও দু’ চারটে গেওয়া, কেওড়া ও সুন্দরী গাছ খুঁজে পাওয়া যাবে।

মরার খবর যেমন আছে, আঙ্গুরবালা, তেমনি আশার খবরও আছে। মনে আছে, চার্লি চ্যাপলিন তাঁর কোনো একটা মুভিতে নায়িকাকে বলেছিলেন, “আস্থা হারিও না, হান্না। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সূর্য্য উঠছে। সেই আলো আমাদের এখানেও আসবে।” গত বছর দশেক আগে একটা ছোট দলে আমরা তিন-চারজন বেরিয়েছিলাম বাদাবীর (Mangrove Warrior) খুঁজে বের করতে। দেখলাম, শ্যামনগরের আবু বকর ও তার ভাই তাঁদের দুই একর সব্জিভিটার চারপাশে লাগিয়েছেন কয়েক শ’ কেওড়া গাছ। রমজান নগরে চরের জমি লিজ নিয়ে আবুল কাশেম লাগিয়েছেন গেওয়া, কেওড়া, সুন্দরী আর বাইন। পাইকগাছার খয়বার গাজী জলাভূমিতে লাগিয়েছেন গোলপাতার ঝাড়। এঁরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যই লাগিয়েছেন এসব গাছ। কিন্তু বীরের মতো কাজ করেছেন। বিজাতীয় আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, নোনাবাবলা আর রেইনট্রি দিয়ে কলুষিত করেননি সুন্দরবন-সংলগ্ন ভূমি।

তোমার ভূবনেও ঢুকতে দিও না কোনো কলুষ বিজাতীয় বীজ, আঙ্গুরবালা!