অপেক্ষা-প্রহরের এলেবেলে

"লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, অ্যাটেনশান প্লিজ। আ'য়্যাম দ্য সিকিউরিটি অফিসার অব দিস ফ্লাইট। অ্যাকর্ডিং টু দ্য সিভিল এভিয়েশান অ্যান্ড পাবলিক সিকিউরিটি ল' অব পিআরসি...।" পিআরসি শুনেই খটকা লাগলো। কান খাড়া করে শুনতে শুরু করলাম। সাধারণত উড়োজাহাজে উঠলে বিমানচালক ও তার সাগরেদরা নানান রকম সতর্কীকরণ ও পলায়ন-কৌশল বিষয়ক জ্ঞান দেন। এ বাণী শুনতে শুনতে যাত্রীদের মুখস্থ হয়ে যায় আর বেয়াড়া না হলে যাত্রীসকল তা মেনেও চলেন। সুতরাং কান দুটো সাধারণত আধোঘুমেই কাটিয়ে দেয়।

পিআরসি মানে পিপলস্ রিপাবলিক অব চায়না। সাধারণভাবে পাইলট বা ক্যাবিন ক্রুরা পুরো নামটা বা সংক্ষেপে চায়নাই বলে, অবশ্য যখন তাদের একটু ইংরেজি বলার মর্জি হয় তখন। তাছাড়া বাকি সময়টা, ‘চ্যাংইয়ং কিফং চিয়া মিং’ বলেই কাটিয়ে দেয়। কে কী বুঝলো আর বললো তাতে তারা থোড়াই কেয়ার করে। সুতরাং 'পিআরসি' শুনে কানের ভলিউম টিউন করতে হলো। পরিস্কার আমেরিকান উচ্চারণ। 'থ্যাংক ইউ' কথাটা 'চ্যাংক ইউ'র মতো শোনাচ্ছে না। ভালো। খানিকটা বোঝা যাচ্ছে। সিকিউরিটি এজেন্সি লাগিয়েছে চীনা এয়ারলাইন্স এটা ভেবে অবাক লাগছিলো। বহুকাল আগে মার্কিন মুল্লুকের উড়োজাহাজে এমন 'স্কাই মার্শাল' না কী যেন একটা পদধারী দেখেছিলাম। নয়-এগারো দুর্যোগের পর তখনকার আগ্রাসী মার্কিন সরকার পরিবহণ নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (টিএসএ) নামে সংস্থার আওতায় ব্যাপকভাবে এদের নিযুক্ত করে। সিঙ্গাপুরে আছে শুনেছি, কিন্তু ঘটা করে জানান দিতে শুনিনি। অন্য কোনো কোনো দেশে আছে, তবে তার কোনোটাতে চড়িনি আমি।

বুঝলাম পুঁজির বিরাট চক্রে জঙ্গিবাদ এক মূর্ত আতঙ্ক আর স্কাই মার্শাল এক বাস্তবতা। কিন্তু চীনে এক বিশুদ্ধ আমেরিকান স্কাই মার্শাল? তাও আবার দেশের নাম বলছে পিআরসি? যাঁরা তাইওয়ান (ফরমোজা বা চায়না তাইপেও বলতে পারেন), হংকং আর ম্যাকাও-এর সম্পর্কে সামান্য জানেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন এই নামের ভেতরেও রাজনীতি আছে। তাইওয়ান নিজেদের সরকারি নাম দিয়েছে রিপাবলিক অব চায়না (আরওসি), হংকং-এর দালিলিক নাম হংকং স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিওন (এইচকেএসএআর), ম্যাকাও-ও বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা। সুতরাং চীনকে শুধু ‘চায়না’ নামে ডাকলে তাইওয়ানকে অবমাননা করা হয় বলে মার্কিনপন্থী (বা চীনবিরোধী) সকলে চীন দেশটাকে পিআরসি নামেই ডাকে।

আরও একটা মজা আছে, চীন সব সময়ই দাবি করে, হংকং, ম্যাকাও ও তাইওয়ান তাদের সার্বভৌম কর্তৃত্বের অংশ। কিন্তু চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে এসব ভূখণ্ডে যেতে হলে আন্তর্জাতিক যাত্রীর যতো নিয়মকানুন সব মেনে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের প্যাসেজ ধরেই যেতে হয়। বহির্গমন লাউন্জের মুখেই লেখা আছে : আন্তর্জাতিক, তাইওয়ান, ম্যাকাও, হংকং এই পথে। এই নিয়মটা দেখে খুব মজা পেলাম। নিজ দেশই যদি হবে তবে আন্তর্জাতিক প্যসেজ দিয়ে যেতে হবে কেন? উইলিকে বললাম। বললো, "নাচাটাও হলো, ঘোমটাও থাকলো; বুঝলি না?" বোঝা যায়, চীন বহু আন্তর্জাতিক সমীকরণ হিসেব করে বিতর্ক এড়িয়ে চলতে চায়। এই বিতর্ক এড়ানোর ভেতর দিয়েই শক্তিশালী রাষ্ট্র হিশেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে। সে চেষ্টা চলতে থাকবে। কিন্তু চীনের উত্থান লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, বেশিদিন সে অন্যদের গোনার মধ্যে ধরবে না।

প্যাসেজ পার হতে হতে এমন কলের মধ্য দিয়ে যাই যে চারদিকে আত্মঘাতি পরঘাতি যে ব্যাপক বোমাবাজ কারবার দেখা যায়, সেখানে চীন, জাপান বা কোরিয়ার নাম কেন শোনা যায় না তা ভাবনা হয়। চীনে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলমানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন করা হচ্ছে বেশ কিছুকাল ধরে। মাঝে মাঝে দাঙ্গাও হয়। তবু কোনো ব্যাপক বিধ্বংসী কার্যক্রম দেখা যায়নি। আর্থরাজনৈতিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু নিরাপত্তা কড়াকড়িও একটা কারণ বলে মনে হয়েছে। উড়োজাহাজ থেকে নামার পর এত স্ক্যানিং চেকিং আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না, যদিও দেখেছি বড়ই কম। কাস্টমওয়ালা চেক করছে, সিকিউরিটিওয়ালা করছে, করছে অন্যেরাও।

চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের স্কাই মার্শাল যে ঘোষণাটা দিলেন তার মর্মকথা হলো, তুমি যদি এই উড়োজাহাজের কোনো জিনিসের ক্ষতি করো, অনর্থক ধাক্কাধাক্কি করো, ক্যাবিন ক্রু বা অন্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দাও, কাউকে হুমকি দাও অথবা অশোভন আচরণ করো তাহলে অর্থদণ্ড সহ বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনের দণ্ড দেয়া হবে। দণ্ডগুলো হাতে দেবে কিনা সেটা আর কনফার্ম করলো না দেখে উইলিকে বললাম, "পানি খাবো।" ও বললো, "ভয় পাইছো?" আমি বললাম, "দণ্ড হিশেবে যদি এখানেই নামিয়ে দেয় তাহলে তো সোজা সাগরে। নোনাপানি। খেতে পারবো না। পেট পুরে স্বাদুপানি চেখে নিই।" একটু হাসলাম দু'জনে।

পানি এলো। চেয়ে আছি, আর কিছু আসে কিনা তার আশায়। এলো সাংহাই বিমানবন্দর, নাশতা না। সকালে ঝটপট চারটে খেয়ে রওনা হয়েছি জেজু দ্বীপের দক্ষিণ থেকে উত্তরের বিমান বন্দরের দিকে। এক ঘণ্টার পথ। কাগজপত্তর, হাজিরা, নিরাপত্তা ইত্যকার যন্ত্রণাদি সেরে এসে বিড়িকেন্দ্রে যাবার মুখেই খিদে পেয়ে গেল। উইলিকে বলতেই বললো, "টাকায় কামড়ায়? বিমানে খেতে দেবে, সেটাই যথেষ্ট!" আমি বললাম, "সে তো দিবে। অন্তত দুটো কুকি আর একটা কফি খাই?" ও রাজি হলো। ফ্লাইটে সবেধন নীলমণি দুই বোতল পানি পাবার পর আমি উইলির দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি দিলাম। উইলি ককপিটের দিকে তাকিয়ে 'বান' শব্দ সহযোগে এয়ারলাইন কোম্পানির প্রতি মধুবর্ষণ করলো।

একই দশা হলো সাংহাই থেকে কুনমিং আসার পথেও। এবার অবশ্য এয়ার হোস্টেসদের মুখে হাসির রেখা দেখা দিলো। কিন্তু বিমানে একটা স্কাই মার্শাল আছে - এই কথা ভাবলে কেউ কি আর পাল্টা হাসি দিতে যায়? তার চেয়ে বাপ-মা'র দেয়া প্রাণটা হাতে নিয়ে ভালোয় ভালোয় জমিনে পা রাখতে পারাটাই বরং মঞ্জিলে মকসুদ হতে পারে। এবারের যাত্রা সাড়ে চার ঘণ্টার এবং একা।

সাংহাইতে বসে থাকতে হলো প্রায় ছ' ঘণ্টা। এই শর্মার গেট নম্বর ২৫৫। ২৫৫'র ঠিক ওপরে ১২ নম্বর গেটের লাউঞ্জে বসে আছি। গর্তের ভেতর ঢুকতে গা লাগছে না। দীর্ঘকালীন বন্ধু ও স্বল্পকালীন সহযাত্রী উইলফ্রেড ডি'কস্টার গেট ১৯। আমরা হোয়াটস্অ্যাপে পরস্পরের ভাব লেনাদেনা করি। আগেই হয়তো বলেছি যে চীনদেশে ফেইসবুক, গুগল, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম - এসব বন্ধ। চীনা কর্তারা বলে দিয়েছেন, আমার দেশের নিয়ম মেনে চলতে পারলে চলো, নইলে নয়। আমাদের স্মার্টফোনসমূহ সব অ্যান্ড্রয়েডে চলে, গুগল ম্যাপের মাপে স্থান দেখায়। তবে এখানে সেসব লবডঙ্কা। অ্যান্ড্রয়েড খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বটে, তবে স্থান দেখায় না। যতোবার ক্লিক করি, কর্কশ টেক্সট দেখায়, "ইয়োর লোকেশন ক্যান'ট বি ডিফাইনড্"!

২০১০ সাল থেকে নিয়ন্ত্রণ শুরু এবং ২০১৪তে একদম বন্ধ হয়ে গেছে গুগল। চীন সংক্রান্ত খবর সেন্সর না করার কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পিনটারেস্ট, স্ন্যাপচ্যাটও। টুইটার বন্ধ হয়েছে ২০০৯ সালে 'আরব বসন্ত'-এর পর যে বসন্ত ইতোমধ্যে গুঁটিবসন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। একই বছর উইঘুরদের দাঙ্গার ব্যাপক প্রচার হয় ফেসবুকে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল পুড়লো ফেসবুকেরও।

ফেসবুক বন্ধ হবার সুবাদে ২০০ কোটি চীনার জন্য গড়ে উঠেছে উইচ্যাট, এক বিকল্প সামাজিক মাধ্যম যা এখানে প্রত্যেকেরই আছে। বিমানঘাটের ফ্রি ওয়াইফাই কানেকশন নিতে হলে আপনার একটি উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট থাকতেই হবে। না হয় কড়ি ফেলতে হবে দস্তুরমতো। পাশাপাশি হোয়াটস্অ্যাপ আর ইমোও চলে। ভাইবার চলে বটে কিন্তু বড়ই শ্লথ তার গতি। অামি ঘণ্টা চারেক চেষ্টা করেও একটা ছবি পাঠাতে পারিনি। এদের ম্যাপের জন্যও আছে নিজস্ব অ্যাপ। সে অ্যাপের নামধাম আমি জানি না। খোঁজাখুঁজির ব্রাউজার বাইদু।

দক্ষিণ কোরিয়ার জেজুতেও দেখলাম গুগল ম্যাপ রিয়েলটাইম নেভিগেশন দেখায় না। পক্ষান্তরে কোরিয়ান ভাষার একটা অ্যাপ হাতে নিয়ে সবাই, ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে পথচারীতক, চলছে দিব্যি। সব সক্ষম দেশ এখন গুগলকে বলছে, আমার দেশের নাগরিকদের তথ্য বাইরের বাজারে ছাড়া যাবে না আর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যার ভিত্তিতে যেহেতু বিজ্ঞাপন থেকে তোমরা টাকা পাও সেহেতু দেশকে পয়সা দিতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া আর চীন দেখালো, বাজার বা প্রযুক্তি যা-ই হোক না কেন, আপনার দক্ষতা ও সম্পদ ক্ষমতারও পরিচায়ক।

সেই দমবন্ধ (অভ্যেসের কারণ) সময়ে এপাশ ওপাশ হোয়াটস্অ্যাপে গুলতানি মারা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হঠাৎ মনে হলো চারটে গেট পরেই বন্ধু বসে আছে, একবার ঢুঁ মেরে আসি। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দেখি ১৫ নম্বর গেট পর্যন্ত আভ্যন্তরীণ যাত্রার জন্য নির্ধারিত। ১৬ নম্বর থেকেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের গেট শুরু। আর ১৫ নম্বরের পরেই তুলে দেয়া হয়েছে লম্বা দেয়াল। কোনো ফাক-ফোকর নেই। আমাদের গাঁয়ে হলে এপার ওপারে কয়েক দফা উচ্চস্বরে কথাবার্তা চলতে পারতো। কিন্তু এখানে সেটা শুধু নির্বুদ্ধিতার না, ঝুঁকিরও। কেননা জায়গায় জায়গায় লেখা, "সম্মানিত যাত্রী, আপনার নির্ধারিত গেটের সামনে গিয়ে বসুন। এখানে ওখানে ঘোরা সন্দেহজনক। আপনি আমাদের নজরদারির আওতায় আছেন!" এরপর আর কোনো কথা চলে?

সুতরাং ড. য়্যু'র সঙ্গে খাজুরে আলাপ ছাড়া আর কোনো কাজ রইলো না। এ কথা সে কথার পর জিজ্ঞেস করলাম বাড়িতে কে কে আছে। জানলাম একটি কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার তার। জুন নামে তাঁর সহকর্মীরও তাই। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে জানালাম আমিও তাঁদের সহগামী। ড. য়্যু'র হঠাৎ প্রশ্ন, "তোমার দেশেও কি 'এক সন্তান নীতি' আছে?" বললাম, "না। তবে একাধিক সন্তান পোষার ক্ষমতা থাকতে হবে তো!" পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি তাহলে 'এক সন্তান নীতি'র যাঁতাকলে পড়েছো?"
- ঠিক তা না। এক সন্তান নীতি তো তুলে দেয়া হয়েছে!
- কেন? আন্দোলনের কারণে? ওই যে এক সাংবাদিক... লিউ?
- নাহ। ওসব তোয়াক্কা করে না। মনে হয়েছে, তাই তুলে দিয়েছে!

আমরা রাজহাঁসের মাংস খেতে খেতে আলাপ করি। সারা দুনিয়ায় গরিব মানুষের জন্য মুরগির মাংস জনপ্রিয় হলেও এখানে হাঁসের মাংসের দোকানই বেশি। ওঁরাও হাঁসের মাংস কেনেন। মাও ঝে দং-এর ছবিঅলা চল্লিশটি মুদ্রা দিয়ে আমি মসলাবহুল হাঁসের পাখনা কিনি। তা খেতে গিয়ে আমার কালঘাম ছুটে যায়। অত্যাধিক গোলমরিচ ও পুদিনা পাতার ঝাঁঝে আমার চোখের জল নাকের জল একাকার হয়ে বান নামতে দেখে ড. য়্যু আর জুন হাসেন। বোধ করি পাখনাগুলোকে সাতদিন পুদিনা-গোলমরিচে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিলো।

হাতের পলিথিন-দস্তানা আর প্যাকেট ফেলে আসতে আসতে সঙ্গীরা বিদায় নেন। তাঁদের জাহাজ ঘাটিয়েছে যথাসময়ে। এবার রবার্ট ব্রুসীয় উদ্যমে আমি বিড়িকেন্দ্র খুঁজি। ইতোপূর্বে গোটা পাঁচেকবার ইতিউতি ঘুরেও উপযুক্ত জায়গা না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছি। অবশেষে একটা জায়গা পাই। তিন কিস্তি চলসিঁড়ি পার হয়ে একদম মাটির সমতলে। কিন্তু আগে একটা কফি বা চা না হলে বিড়িটা আদৌ জমে না বিধায় প্রধান খাদ্যের সমান দামে এককাপ কফি হস্তগত করে ওদিকে ধাই।

আরো ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে আমায়...

[ফিরে এসে দেখবো আমার উড়োজাহাজের সময় এবং গেট দুটোই পাল্টে গেছে!]