কেওড়ার ঝোল ও মজিদ বাওয়ালি

আঙ্গুরবালা, আজকে সন্ধ্যায় যখন "সুন্দরবনের বাঘের পিছু পিছু" পড়ছিলাম, দেখলাম Khasru Chowdhury ভাই লিখেছেন, "সুন্দরবনে কেওড়া বা ওড়া ফল নিয়ে এমন প্রবাদ চালু আছে -
যে খেয়েছে কেওড়ার ঝোল,
সে ভুলেছে মায়ের কোল।"

উনি লিখেছেন একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন খাদ্যের বাদাবনে কেওড়ার স্বাদ কতোটা কাঙ্ক্ষিত তার প্রেক্ষিতে। আমি যখন কয়রায় মজিদ বাওয়ালির কাছে এই শ্লোক শুনেছি তখন কিন্তু তিনি দুটো প্রেক্ষিত তুলে ধরেছেন। একটা তো তুমি খসরু ভাইয়ের মাধ্যমে জানলেই; আরেকটা হলো বনের মাদকতা, ঘোর বা নেশা। ওই নেশা মায়ের কোলও ভুলিয়ে দেয়, এমন টান! এ কথার পরপরই কয়রার হড্ডি গ্রামের মজিদ সর্দার বলে ওঠেন, "বুজদি পাল্লেন না? এই মানুষ বনে গিলি বনমানুষ অয়!"

তোমাকে বহুবার বলেছি নোনাজল, বাঘ-কুমীর আর সাগর-কাঁকড়ার সুন্দরবনে ঘুরতে যেতে। তুমি দুলেছো তোমার ভেতরে ভেতরে, আরেক বাঘের ভয়ে হয়তো, যে তোমার মনের ভেতরে বসবাস করে, তোমার আত্মা খেয়ে বেঁচে থাকে। আর খায় আমাকেও, কেননা তুমি তো থাকো আমার গভীরেই। অথবা তুমি ওই বাদাবনে যাও, ঘোরো, রাতে ঘুমাও আদাচাই খালের মুখে আমারই সাথে সাথে, আর রাতের নৈঃশব্দের ভেতরে শোনো হরিণের ডাক, যেমন শুনতেন জীবনানন্দ।

কবে প্রথম দেখলাম কেওড়া বা ওড়া, তোমার মনে আছে, অন্তর্বাসিনী? খুব ছোটবেলায়। হয়তো প্রাথমিক উত্তীর্ণ হইনি। সদ্য সাঁতার শিখেছি। চাচাতো ভাই Jamal দাদা পাড় থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে এমনভাবে পুকুরে ফেলে দিতেন যে মরণ বা সাঁতার - এর যে কোনো একটা বেছে নিতে হতো। আমাকে দেখে তো বোঝা-ই যাচ্ছে যে বাঁচাটাই বেছে নিয়েছিলাম। বাঁচার তাগিদে যা শিখতে হয়, সেটা খুবই পোক্ত হয়। তাই পরে সাঁতার কাটতে গিয়ে ভদ্রা নদীটা খুব চওড়া মনে হতো না, যদিও ভারী ভারী লঞ্চ চলতো ওই নদীতে।

পৌষ বা গরমের বন্ধে বেড়াতে যেতাম নানাবাড়ি তেলিখালী। ওই বাড়ির পেছনেই ছিলো একটা সরু খাল। নাম পুবের খাল। সাধারণত টাবুরে বা কেরায়া নৌকোই চলতো সেখানে। ভাটার সময় দুইপাড়ে দাঁড়িয়ে খেপলা জাল (ওঁরা বলতেন ঝাহিজাল, একটা জোর ঝাকি দিয়ে ফেলতে হতো, তাই কি এমন নাম?) ফেলতো পাড়ার লোকেরা। ব্যাপক ঘোলাজল তার। তার ভেতরে পাওয়া যেতো প্রচুর নদীর মাছ। খালটা উত্তরে মিলেছে কচা নদীর সাথে।

জায়গাটা চিনতে পারছো না? তুমি যদি মোরেলগঞ্জ বাজারটার দিকে তাকাও তবে দেখবে পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পানগুছি নদী। ভাটির সময় আকাবাঁকা নদীটা ধরে দক্ষিণে এগোলে আট-দশ কিমি সামনে নদীর ডানতীরে পাবে সন্যাসী। ওহ হো, তুমি যদি টাবুরে বা কেরায়া নৌকোয় যাও তাহলে মোরেলগঞ্জ থেকে রুটি, নারকেল কোরা আর ঝোলাগুড় নিতে ভুলবে না কিন্তু! এক সময় এখানে লাল আটার মোটা মোটা রুটি পাওয়া যেতো। রুটিগুলো সংখ্যায় নয় বরং বিক্রি হতো ওজনে। প্রতিটা রুটি প্রায় আধাকেজি ওজন, ভাবতে পারো? মিষ্টি মিষ্টি ফোলা, নরম রুটি আর সাথে নারকেল-গুড়। ধীরে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে চলতে থাকা নৌকোর গায়ে বৈঠার ঘর্ষণে ঘটটরর ঘটটরর শব্দ! রুটি খেতে খেতে তোমার ঘুম এসে যাবে!

সন্যাসী থেকে আরেকটু এগোলে দেখবে বামদিক থেকে এসে মিশেছে কচা নদী। পানগুছি আর কচা মিলে চলেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে বলেশ্বর। বল বা শক্তির ঈশ্বর। বুঝতে পারছো কেন আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা নদীরও পূজো করতো! মোহনার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে যদি বামদিকে কচানদীর বামপারে তাকাও তবে তুমি পাবে কলারণ গ্রাম, এখানে বালিপাড়া ইউনিয়ন। ডানতীরে তুষখালী খাল দক্ষিণে ঢুকেছে তুষখালী বন্দরের দিকে; এটা কিন্তু মঠবাড়িয়া উপজেলার ভেতরে। আর বলেশ্বরের ডানতীরে রায়েন্দা বন্দর, আজ যা শরণখোলা উপজেলা সদর।

এবার তুমি বামে ঘুরে কচা নদীতে ঢুকে দুই-তিন কিমি সামনে দেখবে হরিণপালা চর। এখন এটা একটা 'ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র' হয়েছে। হরিণপালা ছাড়িয়ে এগোলেই একটা বাতিঘর। বাতিঘরটার সামনেই একটা সরুখাল ঢুকেছে কচা নদী থেকে দক্ষিণে। এখান থেকেই ভাণ্ডারিয়া উপজেলা শুরু হলো। ওই খালটার কথাই বলছি। নদী থেকে এক কিমি দূরে গিয়ে মরে গেছে খালটা। এই এক কিমিই ছিলো নানাবাড়িতে আমার জলচারণসীমা। বেলা বারোটার দিকে ঘোলাজলে নেমে দুপুর পার করে, কাদার গোঁফ গজিয়ে তবেই ফিরতাম বাড়িতে। তারপর শুরু হতো দ্বিতীয় পর্বের ধোলাই এবং চোখের জলে স্নান। বলা বাহুল্য, মা-ই ধোপার কাজটা করতেন।

এর আগেও হয়তো ওড়া দেখেছি বা খেয়েছি, কিন্তু তার স্মৃতি এত ঝাপসা যে আবছা খাওয়ার দৃশ্য ছাড়া কিছুই মনে করতে পারছি না। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝে মাঝে ওড়া পাওয়া যেতো কিন্তু তা খাওয়া হতো ভাগে। একদিন আমি পেয়ে যাই আস্ত একটা ওড়া যার ভাগ আর কাউকে দিতে হবে না জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসছিলো ওটা। পিরোজপুর বরিশালে ওড়া ফলটাকে বলা হয় ছৈলা। কেওড়ার কোনো বিকল্প নাম আমি পাইনি। অন্য কোনোদিন হয়তো খালে একটা পচে ওঠা ওড়া নিরিখ করে খেপলা জাল ফেলতে দেখেছি Anis-এর বাবা, আমার ছোট মামাকে। এরকম ভাসন্ত ওড়াটাকে কেন্দ্র করে নাকি বাটা মাছেরা ঘুরঘুর করে। ছোটবেলায় তাঁর মাছ শিকারে আমি ছিলাম নিত্যসঙ্গী, আমি নাকি পয়া - সৌভাগ্য বহনকারী।

ওড়া বা কেওড়ার বাইরের ত্বকটা বেশ টক, কাচা অবস্থায় একটু কষকষ লাগে বটে, তবে পেকে উঠলে নরম ত্বকটা দারুণ টক এবং একটু বুনোগন্ধ থাকায় অসাধারণ অনুভূতি দেয়। ওই প্রথমদিনের পর আরো বহুবার খেয়েছি কাচা বা পাকা ওড়া, এবং কেওড়া, কিন্তু মনে রাখার মতো কোনো ঘটনা নয় তা। কিন্তু দু' হাজার সালের দিকে যখন দীর্ঘদিনের জন্য আশাশুনির বুধহাটায় গেলাম, তখনকার একদিনের মধ্যাহ্নভোজ আমাকে চিরদিনের জন্য কেওড়ার প্রেমে ফেলে দিলো। সে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি এখনও। সারাজীবন ওই ক্ষুদে সুন্দরীকে ভোলা প্রায় অসম্ভব।

আশাশুনির বুধহাটার এপারেই পাইকগাছার বাঁকা ইউনিয়ন। মাঝখানে মরা কপোতাক্ষ নদ। নদের উপরে একটা কংক্রিটের ব্রিজ, যার রেলিং-এ বসে আমি একাকী বিকাল সন্ধ্যে পার করি মাঝে মাঝে। এক গরমের সকালে ব্রিজ পার হয়ে হেঁটেই যেতে হলো বড়দল এলাকায়। সামান্য বৃষ্টি হয়েছে কয়েকদিন আগে তাই রাস্তায় প্যাচপেচে কাদা। কোনো মোটরবাইক বা ভ্যান চলছে না। নোনাপানির চিংড়ি ঘেরের কারণে কোনো গাছপালা নেই, পুরো ন্যাড়া জনপদ। এরই মধ্যে জিভ বের করে হাফাতে হাফাতে বড়দলে কয়েকটি বাওয়ালি ও মৌয়ালদের পাড়ায় যেতে হলো। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। বিছানো কাজের কাগজ ভিজে কোথাও কোথাও লেপ্টে যাচ্ছে লেখা।

মৌয়াল ছমের গাজীর বাড়িতে 'আমাদি মাছ' ভাজি, মুরগির মাংস, দেশি বেগুন আর ডাল রান্নার কথা বলা হয়েছে আমাদের দলের চারজনের জন্য। টাকাও দেয়া হয়েছে। পইপই করে বলা হয়েছে রান্নায় মরিচ না দেয়ার জন্য। এ অঞ্চল ঝালের জন্য কুখ্যাত। চায়ে কড়া লিকার খাবার জন্যও। দুটো মিটিং সেরে খেতে যখন গেলাম, তখন বেলা পড়তির দিকে। বেগুনের ঝোল আর 'আমাদি' নামের ফ্যাসা মাছ ভাজি পর্যন্ত সহ্য করা গেল। কিন্তু মুরগির মাংস মুখে দেয়ার পর মুখের কপাট বন্ধ করার ক্ষমতা রইলো না, চোখের জল নাকের জল একাকার হয়ে গেল। এরপর ধুম করে কান বন্ধ হয়ে গেল। কথা বলার শক্তিরহিত হয়ে গেলাম। পুরো প্লেট ভাত তরকারি বাতিল করে দিতে হলো।

হাতমুখ ধুয়ে এলাম। লিটারেরও বেশি পানি খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং হাতের ঝাল কিছুটা লোগেছে চোখেও। এবার এগিয়ে এলো কেওড়া দিয়ে রান্না পাতলা ডাল আর ভাত। শুধু কেওড়া দিয়ে টকও রান্না করা হয়। এ ধরনের টক রান্নাকে বলা হয় 'খাটা'। গৃহস্বামীর পরামর্শে মুখে দিলাম সেই টক ডাল। আহা! অমৃত! সব জ্বালা দূর হয়ে গেল। দারুণ স্বাদ তার। ওই অবস্থার কারণে নয়, বরং অন্য সময়ও খেয়ে দেখেছি, কেওড়ার টক ডাল আমার রসনার সাথে কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।

গৃহস্বামীকে জিজ্ঞেস করা হলো, "এত মরিচ দিলেন কেন? মানা করলাম না!" রান্নাঘর থেকে তাঁর স্ত্রী লজ্জানত মুখে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে বললেন, "ইট্টুসখানি ঝাল দিইছি। আর ওই কোড়ইতে যে ঝাল লাইগে ছেলো তাই-ই। তাতেই আপনার ইরাম অবস্থা! টাউনির মানষি ঝাল ছাড়া কেমনি খায়!" তাই ওই এলাকায় মাংস রান্না করলে আমি ঝোলের বদলে কেওড়ার টক দিয়েই খাই। আত্মহত্যা তো বারবার প্র্যাকটিস করা যায় না। না?

তবে কেওড়ার চাটনি, আচার কিংবা শুধু মাখিয়েও খাওয়া যায় খুব ভালো।

তুমি খাবে?