ধানের গল্প, নদীর সাথে

আঙ্গুরবালা, আমাদের একটা নদীপাগল শেখ রোকন ভাই আছেন, তুমি তো তা জানো। তিনি গতকাল জিজ্ঞেস করছিলেন, নদী ও খাদ্যসংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তাঁকে সহায়তা করতে পারবো কি না। আমি তো জানো, নদী ভালোবাসি অন্ধের মতো - বুঝি না কিছুই, কিন্তু ভালোবাসি। তুমিও বাসো জানি, তাই তো দেখতে পাই দাঁড়িয়ে থাকো তোমার ওই নীলাভ লেকের ধারে সারাক্ষণ। যেন অপেক্ষা করছো অনন্তকাল ধরে একটা পানসি নাওয়ের, ভেসে আসবে দিগন্ত থেকে দয়িতকে পিঠে তুলে নিয়ে। রোকন ভাইয়ের আহ্বান শুনেই সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার একটা লোকগল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটার সঙ্গে বাকি যেসব মালমসলা তা আমিই লাগিয়েছি। তাই ক্ষণে গল্প, ক্ষণে আলোচনা। অযথা বকবক না করে গল্পটা বলি তোমায়।

সুন্দরবনে গিয়েছিলো একটা বনজীবীর দল। মৌয়াল বলা হয় তাদের। কেউ কেউ মৌয়ালি বা মৌলিও বলেন। তবে এক বিখ্যাত বাঙলা-কবি এদেরকে ‘বাওয়ালি’ বলেছিলেন। তিনি সে ভুল স্বীকার করতেও রাজি নন। কবিরা কি এমন গোঁয়ার হন, জানি না! প্রতিবছরই গরম পড়লে মধু কাটতে যায় মৌয়ালরা। ভদ্রানদী থেকে শিবসার তুফান পাড়ি দিয়ে জাফা গাঙের ধারে কোকিলমণি বনে নামলো সেই মৌয়ালদের দল। নদীখাল ছাড়া তখন দূরযাত্রার অন্য উপায়ও ছিলো না। আজও এদেশে নৌপরিবহণ সবথেকে সস্তা ও আঁতকা-বিপদমুক্ত। দলটি সঙ্গে নিলো আম কলা বরই নারকেল মৌআলু পানিফল আর অনেক অনেক শাক। অন্য কোনো ফল নিয়েছিলো কিনা জানি না। কারণ, জামরুল আনারস সফেদা আলু মরিচ আর পেয়ারা আসেনি তখনও এই দক্ষিণের নোনাভূমিতে। আসবেই বা কী করে, তখনও পর্তুগিজরা পা দেয়নি যে ভারতবর্ষে!

আতা [Annona squamosa L. (1753)] কিংবা নোনাআতাও [Annona reticulata L. (1753)] আসেনি তখনও ভারতবর্ষে। যখন এলো, তখন সবাই জানতে পারলো নোনাআতার ইংরেজি একটি নাম বুলস্ হেড বা ষাঁড়ের মাথা। আবার পানিফলকেও কিন্তু ইংরেজিতে ‘বুলস্ হেড’ বলা হতো। তাই এক সময় বিধবারা এ দুটো ফল খেতেন না। খাবারের সঙ্গে এমনি করেই সংস্কৃতি জড়িত। নদীর সঙ্গেও নিশ্চয়ই জড়িত তেমন করেই। কেননা বলা হয় ‘মাছেভাতে বাঙালি’। মাছ তো প্রধানত নদী ও জলাশয়ের ফসল। আর নদীর পাড়ের ধানের কথা বলার জন্যই এ গল্প। তার আগে জানিয়ে রাখি, বাঙালি কিন্তু ‘ভেতো বাঙালি’ বা ভাতখেকো হিশেবেও পরিচিত।

বিদেশি ফল বোঝাতে বাঙলায় এক সময় ‘সফরি’ বা ‘সোপরি’ যোগ করার প্রচলন ছিলো। অর্থ হলো বহু নদী সফর করে এসেছে এ ফল। যেমন বার্মার মার্তাবন থেকে আনা কলাকে কোলকাতায় বলা হয় মর্তমান কলা। এই কলাটাকেই বাঙলাদেশে বলা হতো ‘সোপরি কলা’। ‘সোপরি কলা’ পরিবর্তিত হতে হতে এখন নাম নিয়েছে ‘সবরি কলা’ বা ‘শবরি কলা’ [Musa acuminata Colla (1820)]। পেয়ারা [Psidium guajava L. (1753)] নিয়ে এসেছে পর্তুগিজরা। তাই তার বাঙলা নাম হলো 'সফরি আম'। সেটা পাল্টাতে পাল্টাতে এখন বরিশালে শুধু 'হবরি' নামে ডাকা হয়। কুমড়োর [Cucurbita maxima Duchesne (1786)] ক্ষেত্রে হয়েছে আরো মজা। পর্তুগিজরা নৌকায় করে এনেছে বলে একে বর্ধমান অঞ্চলে বলা হতো 'ডিঙিলাউ', 'ডিঙালাউ' বা 'ডিঙাল'। বুঝলে তো, নদী-সাগর-খাল কেমন করে জড়িত বাঙলার খাদ্যে আর খাদ্যের নামে!

যা হোক, গল্পে ফিরে যাই। চালও [Oryza sativa L. (1753)] নাকি প্রচলন হয়নি তখন, এরকমটাই বলা হয়েছে এই লোকগল্পে। নদীখালের বাদাবন সুন্দরবন থেকে নৌকো ভরে মধু নেয়ার আগেই মৌয়ালদের খাবার ফুরিয়ে গেল। কয়েকদিন চললো চরগাদা, হেঁতালের মাথি, কেওড়ার ঝোল, বাগদা চিংড়ি আর নোনাটেংরা খেয়ে। এই খাদ্যগুলোর সবই হয় নদীখালের ধারে বা জলে। রান্নাবান্না করার জন্য সঙ্গে নিয়েছিলো হলুদ, গোলমরিচ, চইঝাল, লবণ আর সন্ধব লবণ। প্রাচীনকাল থেকেই সাগরের সৈকতে আর নদীর চরে লবণ চাষ করতেন ‘মলঙ্গী’ বা ‘মুলঙ্গী’রা। লবণ চাষের চর বলেই খুলনার দক্ষিণপ্রান্তের নাম লবণচরা। দেখেছো, লবণেও নদী! সেই লবণও ফুরিয়ে গেল মৌয়াল দলটির।

কিন্তু কতোদিন আর বুনো খাবার খেয়ে বাঁচা যায়! তাই দলের নেতার কাছে গেল সবাই। দলের নেতাকে তারা বলে মাঝি। মাঝি নদীর শিসে-জোংড়া সব চেনেন, আবার জানেন বাঘ-কুমীর তাড়ানো মন্ত্র। মন্ত্র জানেন বলে মাঝির আরেক নাম ‘বাউল’ বা ‘বাউলে’। সেখান থেকে নাম হয়েছে ‘বাওয়ালি’। মাঝি পরিস্থিতি সব দেখছিলেন। তারপরও ভবিষ্যত দিনে কে কে মাঝি হয়ে উঠতে পারবে তাই যাচাই করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সব বুঝেশুনে তিনি বললেন, ঘোরাও নৌকা। নৌকা ঘোরানো হলো। উত্তরমুখো নৌকো চলছে তো চলছেই, জনমুনিষ্যির দেখা নেই। পশুর নদী ধরে এগোতে এগোতে চলে এলো মংলা নদী। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। সবার পেট চোঁ চোঁ করতে লাগলো। মাঝি এক চরে বড়ো বড়ো শুকনো ঘাস দেখতে পেয়ে সেখানে নৌকো ভেড়াতে বললেন।

চরের বালির ভেতরে ডিম পেড়ে তা দিচ্ছিলো কয়েকটি কচ্ছপ। এগুলোকে কেটো কচ্ছপ, কাইট্টা কচ্ছপ, বোদো কাছিম বা সরাসরি ‘কাঠা’ বলা হয় [Batagur baska (Gray, 1831)]। মানুষের লোভের শিকার হয়ে এখন কেটো কচ্ছপেরা মহাবিপন্ন প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তখনকার অগুণতি কচ্ছপ ছিলো বাঙলার নদীগুলোয়। কচ্ছপকে গাঁয়ের লোকে জলখাসি বলে, কারণ এরা নদীতে থাকে। মৌয়ালরা দাবড়ে দুটো জলখাসি ধরে ফেললো। তারপর হলুদ আর চুইঝালের কাই মাখিয়ে পোড়ানোর আয়োজন করতে লাগলো। নুনের চাহিদা মিটলো নদীর নোনাজলে। বালিতে গর্ত করে চুলো বানানো হলো। আগুন ধরানোর জন্য নিয়ে এলো সেই শুকনো ঘাস। রসুই বসে গেল রাঁধতে।

যেই না আগুনে শুকনো ঘাস দিয়েছে ঠেলে, অমনি ফট ফট করে ঘাসের বীজগুলো ফুটে ফুটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। দু' একজন খিদের জ্বালায় সেগুলো মুখে নিয়ে দেখে, দারুণ স্বাদ! ওদের দেখাদেখি অন্যেরাও তুলতে শুরু করলো পোড়া ঘাসের বীজ। ওদের কাছে এ এক নতুন খাবার, যা নদীর চরে হয়। এবার সবাই সংগ্রহ করতে শুরু করলো ঘাসের বীজ। নিজেরাই আগুনে ফুটিয়ে খেতে লাগলো। খুব আনন্দ করে খেলো সবাই। মাঝিও যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে। তারপর নৌকো নিয়ে রওনা দিলো ছোট একটা খাল ধরে।

মৌয়ালদের দলটি সঙ্গে নিলো কয়েক ধামা ঘাসের বীজ। কিছুদূর গিয়ে দেখলো একটা জেলে পরিবার নদীর ধারে ঘর বেঁধে বাস করছে। তখনকার পরিবারের কিন্তু মা-ই প্রধান ছিলো, এখন যেমন তুমি। মৌয়ালরা জেলে-মায়ের কাছে নিজেদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরলো। তিনি তাদের রাতে থাকতে দিলেন। আপ্যায়ন করলেন হরেক রকম ফল আর খালের মাছ দিয়ে। আপ্যায়নে খুশি হয়ে মাঝি তাদেরকে এক ধামা ঘাস দিয়ে বললেন, এগুলো ছিটিয়ে দিলে সুন্দর ঘাস হবে। সে ঘাসের বীজ ফুটিয়ে খাওয়া যায়। খুব সুস্বাদু।
মৌয়ালরা বাকি বীজ নিয়ে ছিটিয়ে দিলো নিজের বাড়ির চারপাশে। সেখান থেকে গজিয়ে উঠলো নতুন চারা। অনেক বীজ হলো।

এদিকে মাঝির নির্দেশনা ভুল বুঝে জেলে-মা ঘাসের বীজ ফুটালেন জল দিয়ে। আর তাতেই বেরিয়ে এলো তারাকুঞ্জের মতো শাদাভাত। এ-কান ও-কান হয়ে সে সংবাদ পৌঁছুলো মাঝির গ্রামেও। তাঁরা দল বেঁধে এসে জেলে-মা’র বুদ্ধি দেখে আত্মীয়তা পাতালেন। আর নিয়ে গেলেন এই নতুন জ্ঞান। এভাবে নদীর চর থেকে ছড়িয়ে পড়লো সবখানে যে ঘাস, তার নাম ধান। আজও নদীর চরে সেই আদিধান পাওয়া যায় যাকে বলা হয় দূর্বাধান বা খোদাধান [Paspalum vaginatum Sw. (1788)]।

সেই ধানটি সত্যিই দূর্বাধান বা খোদাধান ছিলো, নাকি ছিলো আদিধান [Oryza rufipogon Griff. (1851)], বুনো ধান [Oryza officinalis Wall. ex Watt (1891)], ধানিঘাস (ধানসি) [Porteresia coarctata (Roxb.) Tateoka (1965)] বা উড়িধান (জংলিধান, ফুটকি) [Hygroryza aristata (Retz.) Nees ex Wight & Arn. (1833)] তা আমি জানি না। তবে খুলনার দক্ষিণের গ্রামগুলোয় ধান আবিস্কারের লোককাহিনীর সঙ্গে যখন নদী জড়িয়ে আছে, তখন ধান-ইলিশের বাংলাদেশে খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে নদীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে না, তা তো হতেই পারে না।

ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল - এটা না ভুলে গেলে পুরো উপকূলের খাদ্য ও নদী যে পরস্পর মিলেমিশে আছে - তা আর বলে দিতে হয় না। এটুকুই আমি বুঝেছি। আর তুমি কি বলবে সে তো আমি জানি : “হাসান, আমাকে এই সবগুলো ধান দেখাতে নিয়ে যেতে হবে সুন্দরবনে।” তাইতো?