বাঙলায় প্রবর্তিত ফল

আঙ্গুরবালা, তোমার মনে আছে, কোনো একদিন কথা হচ্ছিলো বাংলাদেশের বিদেশি উদ্ভিদের বাঙলা নাম থাকবে কি না? আমি বলেছিলাম, যে উদ্ভিদ বাঙলায় জন্মাবে এবং বেড়ে উঠবে তারই একটা বাঙলা নাম থাকা উচিৎ। কেউ কেউ বিরোধিতা করেছিলেন। সেদিন আমি বলতে চেয়েছিলাম, মেহগনি, সেগুন, কড়ই থেকে শুরু করে মধুমঞ্জরি পর্যন্ত বহু উদ্ভিদ বাঙলায় এসেছে বিদেশ থেকে, এখানে মানিয়ে নিয়েছে আর পেয়ে গেছে বাঙলা নাম। আজকে হঠাৎ করে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে এখন আর বিদেশি উদ্ভিদ বাঙলা নাম পেতে পারবে না। আজকে তোমার জন্য কতোগুলো ফলের নাম দিলাম।

বাঙলায় প্রচুর ফলের নাম আছে যেগুলো বিদেশি ভাষাজাত। যেমন, অঙ্গুর (বাঙলায় আঙুর, সংস্কৃতে দ্রাক্ষা), বেদানা, কিসমিস, পেস্তা, খোবানি - এগুলো ফার্সি শব্দ। আনারস একটা আইবেরিয়ান শব্দ। প্রসঙ্গত, আইবেরিয়া বলতে পর্তুগাল ও স্পেন মিলে যে অঞ্চল হয়, সেটিকে বোঝায়। ল্যাটিন ভাষায় অঞ্চলটিকে হিস্পানিয়া ও আরবিতে আন্দালুসিয়া বলা হতো।

পর্তুগিজরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আসল নাম আনানস্। রসালো ফল বলে বাঙলায় অপভ্রংশিত নাম দেয়া হয়েছে 'আনারস' [Ananas comosus (L.) Merr. (1917)]। বাঙলায় আনারস দু' রকম : এক. ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আনা কাঁটাহীন ও বড়ো আকারের আনারস যাকে সাধারণত সিঙ্গাপুরী আনারস বলা হয়। এবং দুই. কাঁটাওয়ালা ছোট আকারের ও সোনালি রঙের আনারস। আসাম ও ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সিলেট-চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে যে ছোট 'দেশি আনারস' জন্মায় সেগুলো মোটেই দেশি নয়। কোনো কোনো এলাকায় একে বারুইপুরি আনারসও বলা হয়। এই আনারস পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ওলন্দাজরা এনেছিলো। ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, ব্রুনেই, ফিলিপাইন, পাপুয়া নিউগিনি, সিঙ্গাপুর, পূর্ব তিমুর ও ক্রিসম্যাস দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত অঞ্চলকে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়।

শিয়ালের সংস্কৃত নাম শৃগাল, শিবা, জম্বুক বা জম্বু। তাই, শিয়াল যে ফল খেতে ভালোবাসে তার সংস্কৃত নাম জম্বুফলম্। বাঙলা অপভ্রংশে জম্বুফলের নাম হয়েছে 'জাম' (Syzygium cumini (L.) Skeels)। সংস্কৃতে জামের অপর নাম ফলেন্দ্র বা ফলশ্রেষ্ঠ। উত্তর ভারতে 'জম্বুফল' হয়ে গেছে জামুন। ফলেন্দ্র থেকে হিন্দিতে হয়েছে ফলেন্দর।

মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে পেয়ারাকেই 'জাম' বলা হয়। পেয়ারাও এদেশে এনেছে পর্তুগিজরা। আইবেরীয় শব্দ 'পিয়ারো' থেকে বাঙলায় 'পিয়ারা' বা 'পেয়ারা' ও মারাঠি ভাষায় 'পেরু'(Psidium guajava L.)]। রাঢ় অঞ্চলে (ছোট নাগপুর মালভূমি থেকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অবধি এলাকা - বর্তমান বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর অঞ্চল) পেয়ারাকে বলে ‘আঁজির’ বা ‘আঞ্জির’। ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে এরই নাম ‘টামরস’। বিহারে পেয়ারার আরেক নাম ‘সফলি আম’। ময়মনসিংহ-সিলেট অঞ্চলের আদি ভাষায় পেয়ারাকে বলা হয় 'সফলি আম', 'সফরি আম' বা 'সোপরি আম'। আর বরিশালে তো পেয়ারার নাম ‘সফরি’ বা ‘সবরি’ থেকে হয়ে গেছে ‘হবরি’।

বিদেশি অর্থে বাঙলায় এক সময় ‘সফরি’ বা ‘সোপরি’ যোগ করার প্রচলন ছিলো। যেমন বার্মার মার্তাবন থেকে আনা কলাকে কোলকাতায় বলা হয় `মর্তমান কলা', পশ্চিম দিনাজপুরে বলা হতো ‘অনুপম কলা’ আর বাঙলাদেশের কোথাও কোথাও বলা হতো ‘সোপরি কলা’। এখন ‘সোপরি কলা’ পরিবর্তিত হয়ে নাম নিয়েছে ‘শবরি কলা’ বা ‘সবরি কলা’ (Musa acuminata Colla)]। কলার দুটো সংস্কৃত নাম আছে, ‘কদলি’ ও ‘রম্ভা’। কদলি মানে কাঁচকলা, যেটা রান্না করে খাওয়া হয়। আর `রম্ভা' হলো পাকা কলা।

সুপারি বা সুপুরিও (Areca catechu L.) বাঙলা শব্দ নয়। ‘সুপারি’ শব্দটা এসেছে হিন্দি থেকে। খাঁটি বাঙলা শব্দ হলো ‘গুয়া’ যা থেকে আধুনিক লৌকিক সংস্কৃত শব্দ ‘গুবাক’ তৈরি হয়েছে। ‘গুবাক’ ও ‘পুঙ্গিফলম্’ শব্দ দুটো প্রাচীন তো নয়ই, আধুনিকও নয় - একেবারে অত্যাধুনিক। সুপারিকে উর্দুতে বলে ‘কশৈলি’, লক্ষ্নৌ অঞ্চলে ‘ডালি’ও বলা হয়। দু’শ বছর আগেও সুপারিকে ‘গুয়া’ বলা হতো। সেখান থেকেই এসেছে গুয়াবাগান, গুয়াহাটি (বর্তমানে গোহাটি), গুয়ামৌরি - এসব নাম সেখান থেকেই এসেছে।

জামরুলও বাঙলার ফল নয় (Syzygium samarangense (Blume) Merr. & L.M.Perry)। এটাও পর্তুগিজরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে নিয়ে এসেছে। আর আতা এনেছিলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। ‘আতা’ (Annona squamosa L.) শব্দটাও পর্তুগিজ। উর্দুতে বলা হয় ‘শরিফা’, হিন্দিতে ‘আতা’র কোনো নাম নেই। চলতি সংস্কৃততে যে ‘সিতাফল’ বলা হয় সেটা শুধু আধুনিকই নয় - অত্যাধুনিক লৌকিক শব্দ। সিতা মানে শাদা জিনিস বা চিনি। চিনির মতো মিষ্টি ফল বলে হয়তো আধুনিক সংস্কৃততে ফলটার নাম সিতাফল দেয়া হয়েছিলো। ‘সিতাফল’, কিন্তু ‘সীতাফল’ নয়। ‘সীতা’ মানে রামের পত্নী বা কর্ষিত ভূমি, আর ‘সিতা’ মানে চিনি। নোনা (Annona reticulata L.) শব্দটিও বাঙলা নয়। এটিও দক্ষিণ আমেরিকার ফল। কলাম্বীয় শব্দ ‘আনোনা’ থেকেই ‘নোনা’ শব্দটা এসেছে। বাঙলায় ‘নোনা’ বলতে লবণাক্ততাও বোঝায় বলে ইদানিং ‘নোনা আতা’ নামে ডাকা শুরু হয়েছে। সংস্কৃত বা হিন্দিতে এর কোনো নাম নেই। আধুনিক সংস্কৃত ও হিন্দিতে এটাকে ‘রামফল’ নাম দেয়া হয়েছে।

সফেদাও বিদেশি ফল (Manilkara zapota (L.) P.Royen)। এটাও পর্তুগিজরা এনেছিলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। আসল নাম তার ‘সাপোটা’। সাপোটা শব্দ অপভ্রংশে হয়ে গেছে সফেদা, সেখান থেকে সবেদা। আধুনিক উর্দুতে নাম রাখা হয়েছে ‘চিক্কু’। উত্তর ভারতীয় অঞ্চলের ফলের সংস্কৃত নাম ‘কণ্টকিফলম’ থেকে হয়েছে ‘কাঁটাল’। কাঁটাল অপভ্রংশে হয়ে গেছে ‘কাঁঠাল’ (Artocarpus heterophyllus Lam.)। অসমীয় ভাষায় এর নাম ‘কটাল’, বিহার ও উত্তর প্রদেশে ‘কটহল’। পাকা কাঁঠালকে সংস্কৃততে বলা হয় ‘পনস’। উড়িষ্যা, মারাঠা ও মধ্যপ্রদেশে কাঁঠালের বদলে ‘পনস’ নামটি বেশি প্রচলিত।

এমনকি যে তামাক (Nicotiana tabacum L.) নিয়ে বাঙালির বনেদিয়ানা, সেটাও বাঙলার আদি ফসল নয়। পর্তুগিজরা নিয়ে আসে এই নেশাদ্রব্যও। আইবেরীয় শব্দ ‘তমব্যাকো’ থেকে ইংরেজিতে টোব্যাকো। একই উৎস থেকে তোম্বাকু। সেখান থেকে তামুক, তারপর তামাক। কোথাও কোথাও তাংকুও বলা হতো। তামাক খাওয়া হতো ডাবাহুঁকোতে। ডাবাহুঁকোর ‘ডাবা’ শব্দটি এসেছে ‘ডাব’ (নারকেল) থেকে। নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি হয় বলে এর নাম ‘ডাবাহুঁকো’।

মিষ্টি কুমড়ো বা লাল কুমড়োও (Cucurbita moschata Duchesne) এদেশীয় নয়। এটা পর্তুগিজরা এনেছিলো পর্তুগাল থেকে। এটা দেখতে সূর্যসম গোল বলে গ্রামে কেউ কেউ ‘সুয্যিকুমড়ো’ও বলতেন এক সময়। ময়মনসিংহে প্রচলিত ছিলো আরেকটি নাম, ‘বিলাতি লাউ’। বর্ধমান অঞ্চলে বলতো ‘ডিংলা’ বা ‘ডিঙিলাউ’, অর্থাৎ যে লাউ বিদেশ থেকে ডিঙিনৌকায় ভেসে এসেছে তার নামই ডিঙিলাউ। তবে লাউ এদেশি ফল। এর সংস্কৃত নাম ‘অলাবু’। অলাবু থেকেই অপভ্রংশে হয়ে গেছে লাউ।

আমও (Mangifera indica L.) দেশি ফল। ফজলি আম নামের পেছনে রয়েছে একটা গল্প। আগে এই আমের বাঙলা নাম ছিলো ‘বালিশ আম’। একবার মালদহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গ্রামের পথে ক্লান্ত হয়ে এক বাড়িতে গিয়ে এক গ্লাস পানি চান। গ্রাম-বাঙলায় কেউ খালি পানি খেতে দেয় না। ইংরেজের ভয়ে বাড়ির কুলবধু তার মেয়েকে পাঠিয়ে দেন পানি আর একটা আম দিয়ে। আমের আকার দেখে ইংরেজ সাহেব জিজ্ঞেস করেন, “ইহার নাম কী আছে?” মেয়েটা মনে করে যে তার নাম জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। সে বলে, ‘আমার নাম ফজলি’। সাহেব ভাবলেন, আমটির নামই ফজলি। তারপর শহরে ফিরে সাহেবের কাছ থেকে অন্য সাহেব হয়ে বালিশ আমের নাম হয়ে গেল ফজলি আম। 

যে পর্যন্ত পেয়েছি, তুলে দিলাম আজকে। আরেকদিন আবার হবে। কেমন?