উপকূলীয় বেড়িবাঁধ : কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা

সালটা ১৯৫৭। তার আগের তিন বছর পরপর বন্যায় ধুয়ে দিয়ে গেছে পূর্ববঙ্গ - তখনকার পূর্ব পাকিস্তান। তাই জাতিসঙ্ঘ থেকে একদল পানি ব্যবস্থাপনা 'বিশেষজ্ঞ' পাঠানো হলো। তারা বন্যাটাকে কবর দিতে চান, বিশেষত শেষ করে দিতে চান ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী জলোচ্ছ্বাস (storm surge) ও সাধারণ জোয়ারোচ্ছ্বাস (tidal surge)। কারণ, এই দুটোর ফলেই আবাদি জমি প্লাবিত হয়, নোনাজল ঢুকে পড়ে এই দক্ষিণ বাঙলার গাঁয়েগঞ্জে। তাতে ফসলের উৎপাদন কমে, খাবারের সরবরাহ কমে আর বেড়ে যায় লালপার্টির উৎপাতন। লালপার্টি মানে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ধনবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তখন দুনিয়ার দখলিস্বত্ব নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। লড়াইটা যুদ্ধের মতো নয় বটে, তবে সেয়ানে সেয়ানে টেক্কা দেয়া চলে। তাই একে বলা হতো ঠাণ্ডা লড়াই।

জাতিসঙ্ঘের ওই বিশেষজ্ঞ দলটার নাম ছিলো 'ক্রুগ মিশন' যার নেতৃত্ব দেন জুলিয়াস অ্যালবার্ট ক্রুগ (Julius Albert Krug)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান। পরবর্তীতে মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও হয়েছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এলেন বন্যা বিশেষজ্ঞের রূপ ধরে। দীর্ঘকাল তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী ছিলেন বটে। কিন্তু বন্যাদমন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ-পর্ষদের প্রধান কী করে হলেন, এ প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে এমন : এই মিশনের অর্থ সরবরাহ করেছিলো মার্কিন আন্তর্জাতিক সহায়তা দপ্তর (ইউএসএআইডি)।

ক্রুগ মিশনের প্রস্তাব ছিলো, পুরো উপকূল ও এর নদীখালের পাড় বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে এবং জলকপাট (স্লুইচ গেট) বসিয়ে জোয়ারভাটার জল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে নোনাপানি কোনোভাবেই জমিতে ঢুকতে না পারে। এই ব্যবস্থাটার নাম পোল্ডার (Polder) যার ধারনা এসেছে নেদারল্যান্ড থেকে। এ কারণেই নেদারল্যান্ডের আরেক নাম পোল্ডারল্যান্ড।

এটা অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু এখানকার চাষিরা যে হাজার বছর ধরে প্রকৃতির বাঁশির সুরে নিজেদের জীবন-জীবিকার গান বাজাচ্ছিলো, তার কী হবে? সেই ১৯৩০ সালে প্রকাশিত বইয়ে উইলিয়াম উইলকক জানাচ্ছেন বাঙলার সব খাল প্রাকৃতিক নয়। স্থানীয় কৃষকরা খাল কাটা ও বেড়িবাঁধ ব্যবস্থাপনার এক অনন্য সামাজিক পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছিলো। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, তৎকালীন মধ্য এশিয়ার প্রথাগত পানি ব্যবস্থাপনার সাথে তার মিল আছে কিছুটা। মুঘলরা এ ধারণা মধ্য এশিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলো, নাকি এখান থেকে ধারণাটা বিস্তৃত হয়েছে মধ্য এশিয়া অবধি, এ তর্কের মীমাংসা না খুঁজেই বলা যায়, স্থানীয় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে উঠেছিলো এই ভাটি বাঙলায়।

সেই ব্যবস্থাপনার মধ্যে ছিলো ছয়মাস মেয়াদি ষষ্ঠমাসী আর আটমাস মেয়াদি অষ্টমাসী নিচু বেড়িবাঁধ। স্থানীয় মানুষ বলতো ষষ্ঠমাসী বাঁধ বা অষ্টমাসী বাঁধ। যখন নদীখালে নোনাপানি বেড়ে যেতো তখন বাঁধ দিয়ে তার অনুপ্রবেশ ঠেকানো হতো। আর বর্ষাকালে মিঠাপানি বাড়লেই কেটে দেয়া হতো বাঁধ, অবাধে ঢুকতো জল। সাথে চলে আসতো নানান রকম মাছের রেণুপোনা বা ধানিপোনা। বর্ষায় রোপন করা হতো জালি আমন যা জলের সাথে সাথে বেড়ে উঠতো ১৫-২০ ফুট অবধি। আজও গোপালগঞ্জ-ফরিদপুরের বিল এলাকায় জালি আমনের চাষ করা হয়। খাটো খাটো বাঙালির ভরসা ছিলো লম্বা লম্বা ধান।

বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও কর্তনে যারা সরাসরি কাজ করতেন তাদের সামাজিক পদবি 'সানা'। আলতাফ সানা আর হরেন সানা কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে বাঁধ পাহারা দিতেন, দেখাশোনা করতেন, মেরামতিতে শ্রম দিতেন। রহিম সর্দার আর রমেশ সর্দার একই কাজ করতেন - বেড়িবাঁধের তত্ত্বাবধায়ন বা সুপারভাইজরি। আর মলঙ্গীরা লবণ চাষ করতেন, মণ্ডল (মোড়ল) বাড়ির উঠোনে মণ্ডলীরা নিতেন সিদ্ধান্ত। উপকূলের নানান জায়গায় লবণচাষ হতো। খুলনা নগরীর দক্ষিণপ্রান্তের নাম ‘লবণচরা’। রূপচাঁদ সাহা ওখানে লবণচাষ করে কোলকাতায় বিক্রি করতেন বলেই জায়গার নাম লবণের চর বা লবণচরা।

আবাদি জমির চারধারে গ্রামের মানুষ নয়ানজুলি, বেড় বা হাড়া তো কাটতোই, একটু বড়ো খাত হলে তার মাঝখানে থাকতো আস্ত কুয়ো। কোথাও কোথাও আদিগন্ত আবাদি জমির মাঝে মাঝে ভিটা বানানো হতো যার মাঝখানে একটি পুকুর ছাড়াও চারপাশে শীতলকারী ফলদ ও বনজ গাছ থাকতো। শুষ্ক মৌসুমে চাষের জন্য সেচ দরকার হতো। সেই উদ্দেশ্য খোঁড়া হতো এই পুকুর-কুয়ো-বেড়। এগুলোতে মাছও হতো প্রচুর। প্রতিবছর ধান কাটা শেষে মাছ ধরার উৎসব হতো। উৎসবের অংশ ছিলো সকলে - হাওলাদার মণ্ডল জমাদার রিশি শেখ সানা সরদার - সবার সেখানে সমান ভাগ। সামন্ততান্ত্রিক সম্ভ্রম প্রকাশের বৈষয়িক দিকটা অবশ্য ছিলো। তাই আজকের দিনে যারা কৃষিজমিতে অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের বিপক্ষে কথা বলেন, তাঁরা বাঙলার আবহমান ফসল-মাছের যৌথ চর্চার বিষয়টা একদমই জানেন না সেটা বোঝা যায়।

ক্রুগ মিশনের প্রতিবেদন অনুসারে বেড়িবাঁধের প্রস্তাব নেয়া হলো। বেড়িবাঁধের জন্য টাকা দিতে এগিয়ে এলো বিশ্বব্যাংক। পরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থলগ্নিকারীরাও এসেছিলো টাকা নিয়ে। ঋণের টাকায় গঠিত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প (Coastal Embankment Project - CEP)-এর আওতায় উপকূলের নদীগুলো বাঁধা হলো ৪ হাজার ১০০ কিমি বেড়িবাঁধের শেকলে। খালগুলো বন্ধ করে মুখে গরুর ঠুঁসির মতো পরানো হলো ১,০৩৯টি স্লুইস গেট বা জল নিয়ন্ত্রক। এবার বেশ হলো। জল ঢুকবে না, তাতে ধান হবে, তাতে চাষার পেট ভরবে, তাতে চাষা চিল্লাবে না, তাতে সামরিকতন্ত্র থাকবে, তাতে সমাজতন্ত্র হবে না।

কিন্তু যে জমিতে জল নেই সেখানে জালি আমন চাষ হবে না। তাহলে বীজ কোথায় পাওয়া যাবে? কারখানায় তৈরি হলো বন্ধ্যা বীজ। গালভরা নাম তার গফফার - উফশী বা উচ্চফলনশীল জাত। আমদানি হলো। তাতে মার্কিন আর তার পোষা বন্ধু ফিলিপাইনের ব্যবসা হলো। কারণ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) প্রতিষ্ঠানটা ফিলিপাইনে অবস্থিত। এতে তৎকালীন বঙ্গদেশের একটু ঋণ বেড়ে গেল। এ আর এমন কী!

কিন্তু সমস্যা আরেকটা রয়ে গেল। আগে জমিতে যখন জোয়ারের বা বন্যার জল আসতো, সঙ্গে আনতো পলি। সুন্দরবনের পাশের নদীগুলো দিয়ে বছরে প্রবাহিত হয় ১১৬ কোটি টন পলি। বেড়িবাঁধ দেয়ার ফলে এই পলি আর আবাদি জমিতে পড়ে না। ফলে জমির ঊর্বরতা কমে। জমির ঊর্বরতা না থাকলে ফসল ভালো হবে না। তাহলে উপায়? উপায় তো আছে। মার্কিন আর তার আরেক দাসবন্ধু জাপানের কাছে রাসায়নিক সার আছে। আমদানি করা রাসায়নিক সার দেয়া হলো কৃষকদের। আর কৃষক ধীরে ধীরে নির্ভর হয়ে পড়লো কারখানার সারের উপর, যেমনি নিচ্ছে কারখানার বীজ।

মরার দেশে সমস্যার তো অভাব নেই! আগে ধানক্ষেতে জল ছিলো ১০-১৫-২০ ফুট। ধানগাছ ডুবে থাকতো ঢলের পানিতে। তাই পোকা লাগতো না সচরাচর। কিন্তু এখন জল নেই। আবার নতুন জাতের এই ধান একেবারে ধনীর দুলালীর মতো। মাজরা পোকা, পামরী পোকা - হেন কোনো পোকা নেই যে তাকে আঘাত করে না। আর সেও পোকা এলেই ভয়ে বা দুর্বলতায় নেতিয়ে পড়ে। এখন উপায়? সিবা গেইগি আছে তো! বিনামূল্যের কীটনাশক ধীরে ধীরে এমর মহার্ঘ্য হয়ে উঠলো যে তিন বছরে পুঁজি দেড়শো শতাংশ বেড়ে গেল। ২০১৬ সালের এক হিসাব বলছে যে প্রতিজন বাঙালি গড়ে বছরে ৪৭০ গ্রাম কীটনাশক খায়।

যা হোক, বেড়িবাঁধের গল্প শেষ হবার আগেই জানা গেছে যে, এই সবকিছু করা হয়েছে 'সবুজ বিপ্লব'-এর নামে এবং বঙ্গদেশে সমাজতান্ত্রিক জোয়ার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বঙ্গদেশ স্বভাবেই অন্যরকম যে ইতিহাসের সারাটা জীবন ধরে হয় ভুগেছে, না হয় শাসককে চোখে আঙুল দিয়েছে, "দ্যাখো, রাজা ন্যাঙটো!"

এখানকার প্রকৃতিই এমন। ১৯৬০-১৯৬৯ পর্যন্ত উন্নয়নের দশক পালন করা হলো। এরপরেই শুরু হলো প্রকৃতির প্রতিঘাত। সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীগুলো দিয়ে প্রতি বছর ১০৬ কোটি টন পলি প্রবাহিত হয়। এই পলিই জমা হতো আবাদি জমিতে। এখন যে পলি আবাদি জমির উপর জমতো আর ক্রমশ উঁচু করতো জলাভূমিগুলো, সেই একই পরিমাণ পলি জমা হতে থাকলো নদীর তলদেশে। কেননা পলি যাবার আর কোনো জায়গা নেই। এভাবে নদী মরতে থাকে। নদীর তলা ভেসে ওঠে মরা ইলিশের পিঠের মতো।

এদিকে দক্ষিণ হিমালয়ী প্লেটের আবশ্যকীয় সরণ ও ভূমি গঠনের প্রক্রিয়া অনুসারে দেশের দক্ষিণাঞ্চল প্রতি বছর কমপক্ষে ৪ মিমি পর্যন্ত অবনমিত হয়। একদিকে ভূমির অবনমন, আরেকদিকে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়া - এটা চলতে চলতে ১৯৮০ সাল নাগাদ অনেকগুলো নদীর তলদেশ জমির তুলনায় উঁচু হয়ে গেল। ফলে উজানের স্রোত ও বৃষ্টিপাতের পানি জমা হবার একটাই জায়গা রইলো, আবাদি জমি। প্রত্যেকটা পোল্ডার পরিণত হলো বর্ষাজলের পকেটে। খুলনার বিল ডাকাতিয়া; যশোরের বিল খুকশিয়া, ভবদহ, বিল কেদারিয়া, বিল বকর; সাতক্ষীরার জেঠুয়া, পাখিমারা বিলসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে যেতে শুরু করলো বছরের সাতমাস ধরে।

প্রতিবেশ বিবেচনাহীন প্রকৌশল আর প্রযুক্তি যে কতোটা আত্মঘাতি হতে পারে তা প্রকৃতিই প্রমাণ করে দিলো। আর মানুষ আন্দোলন শুরু করলো প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় ফিরে যাবার জন্য, কেননা ইতোমধ্যে সরকার আরো কয়েক শ' কোটি ঋণের টাকা খরচ করে ফেলেছে। সবই নদীর জলে ভেসে গেছে। জনতার দুর্ভোগ তো কমেইনি বরং নব্যধনী ঠিকাদারেরা সমাজে নতুন সমস্যা তৈরি করেছে। অর্ধযুগ জলাবদ্ধ থাকার পর জনতা নামলো রাস্তায়। সে আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে পুলিশের গুলির মুখে কৃষকরা সন্ধ্যা নদীর ছয়টি স্থানে বেড়িবাঁধ কেটে দেয়। বানের মতো জল ঢোকে নদী থেকে আবাদি জমিতে। আবার ভাটায় সে জল বেরিয়েও যায়। এই আসা-যাওয়ার মাঝে জোয়ারভাটা জমিতে ফেলে যায় পুষ্ট মিহি পলি, গাঁয়ের লোকে বলে 'সরকাদা'। এভাবে ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে ওঠে বিল ডাকাতিয়ার জমি। অপরদিকে মরা নদীর পলি সরে গিয়ে নাব্য হয়ে উঠলো সন্ধ্যা, হামকুড়া, ভদ্রা।

জনগণ এ পদ্ধতিকে বললো 'জোয়ারাধার'। একে একে কায়েমী আইন ভেঙে তারা জোয়ারাধার বানালো ভরত-ভায়না ও বিল খুকশিয়ায়। নাব্য হলো হরি, শ্রীহরি, মুক্তেশ্বরী নদী। বিশেষজ্ঞরা এলেন এদেশ সেদেশ নানাদেশ থেকে। সব দেখেশুনে বললেন, "আমারো ছিল মনে, কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে"। তাঁরা এর একটা গালভরা নাম দিলেন : টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট)। কেউ কেউ বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ও নামটা বড়ো পানসে। এটার নাম হওয়া উচিৎ "টাইডাল সেডিমেন্ট ট্রাপিং সিস্টেম"। জনতা মুচকি মুচকি হাসে। সরকারও শেষ পর্যন্ত বললো, উপকূলীয় জল ব্যবস্থাপনার সবথেকে কার্যকর উপায় হলো টিআরএম। তারপর সরকার নানান বিলে টিআরএম চালু করার চেষ্টা করছে ।

সুন্দরবন ঘরানার পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, এই বেড়িবাঁধের ইতিহাসের সঙ্গে সুন্দরবনের সম্পর্কটা কোথায়? সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট নয় বটে, কিন্তু একটা সম্পর্ক তো আছেই। এই যে সুন্দরীর আগা মরে যাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন এটা একটা রোগ। তাঁরা ধারণা করছেন, লবণাক্ততা বেড়ে যাবার কারণে এ রোগ হয়েছে। সাগরের নোনাপানির সাথে মিঠাপানি মিশে যে ঈষৎ নোনা প্রতিবেশ তৈরি হয় সেখানেই বাদাবন (Mangrove Forest) গড়ে ওঠে। সুন্দরী হলো বাদাবনের একটি গৌণবাদা (Minor Mangrove) যাকে একইসঙ্গে সাদাবাদা (White Mangrove) গোষ্ঠীর মধ্যেও ফেলা হয়। সাদাবাদা বলা হয় এ কারণে যে এ ধরনের বাদাগাছ বাদাবনের সবথেকে উঁচু অঞ্চলে হয়, কেননা এসব গাছ বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না।

লবণাক্ততা বেড়ে যাবার কারণ কী? কারণ তিনটে : এক. নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধসহ গণ্ডায় গণ্ডায় আড়বাঁধ দিয়ে অবরোধ পদ্ধতির পানি ব্যবস্থাপনা; দুই. নদী মরে গিয়ে উজানের অবশিষ্ট মিঠাপানিটুকুও ভাটিতে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তিন. সুন্দরবনের মধ্যে অতিরিক্ত পলি জমে ছোট ছোট জলাভূমি তৈরি হওয়া। এ তিনটির দুটি কারণের সঙ্গে সরাসরি উপকূলীয় বেড়িবাঁধ জড়িত। খোদ নেদারল্যান্ডেই এখন বেড়িবাঁধ কেটে আবার পলি ঢোকানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে প্রতিবেশ বাঁচাবার জন্য। আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়, স্রোতের অভাবে পলি জমে জমে শুধু উপকূলীয় নদীই না, সুন্দরবনের মধ্যের নদী-খালও মরে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে সুন্দরবনে কোন ধরনের গাছ টিকে থাকবে তা নিয়ে শঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে।

বেড়িবাঁধের ফলে সুন্দরবন-সংলগ্ন মানুষের জীবন-জীবিকার ঝুঁকি কমে উন্নতি হয়েছে বলে প্রায়শই জোর গলায় জানানো হয়। ব্যাপারটা হয়েছে 'হাবোড় (হাঁটুকাদা) থেকে বাঁচার জন্য ফাঁসিকাঠে গিয়ে দাঁড়ানো'র মতো। প্রথম এক দশক (১৯৬০-১৯৭০) অনেক ফসল হয়েছে বটে, তারপরে যে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে তা শুধু ফসল কেড়ে নিয়েই শান্ত হয়নি, কেড়ে নিয়েছে ঘরবাড়িও। এখন এমন অবস্থা যে কোথাও কোথাও গ্রামগুলোর গড় উচ্চতা নদীর তলদেশের চেয়েও কম, ফলে পানি একবার ঢুকলে আর বেরোবার কোনো জায়গা নেই।

তবু বেড়িবাঁধের পক্ষে প্রচার চালানো হয়, আর সে প্রচারে বলা হয় ঘূর্ণিঝড় আইলার (cyclone Aila) কথা। বেড়িবাঁধ ভেঙে আইলার নোনাজল ঢুকে গিয়েছিলো বাংলাদেশ উপকূলের ২২৫ গ্রামে। বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। বলা হয় যে আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের জল যেন ঢুকতে না পারে সেজন্য বেড়িবাঁধ দরকার। কিন্তু একবার জল ঢুকলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে তার অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগরের বাসিন্দা গ্রামের গরিব মানুষ, যাঁরা এই বেড়িবাঁধের পরিকল্পনা বা নকশার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন।

এ মুহূর্তে বেড়িবাঁধ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জনবসতি টিকে থাকবে না, এটাও সত্য। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে ২০১২-২০১৫ সালে পরিচালিত মার্কিন ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়। ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, গত পঞ্চাশ বছরে সুন্দরবনের ভূখণ্ডের উচ্চতা বেড়েছে প্রায় দেড় মিটার। পক্ষান্তরে পলিহীনতা ও স্বাভাবিক অবনমনের ফলে সুন্দরবন-সংলগ্ন দাকোপের কালাবগী গ্রামের উচ্চতা কমে গেছে প্রায় আধমিটার। ফলে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে কালাবগী গ্রামটি প্রায় দুই মিটার বা ছয়ফুট নিচু হয়ে গেছে। তাই কালাবগী গ্রামটি কোনো কারণে প্লাবিত হলে জল যাবার কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না।

এদিকে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় মোট জল-ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিক জোয়ারের জলও নদীর পাড় উপচে চলে আসছে গ্রামের ভেতরে। জল উপচে আসার আরেকটা কারণ আছে। সেই বাষট্টি সালের নকশা অনুসারে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ, বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার মিটার উঁচু এবং উপরে চার মিটার চওড়া হবার কথা। এছাড়া ঢালের অনুপাত গ্রামের দিকে ১:২ ও নদীর পাড়ের দিকের ১:৩ হবে বলেই বিধান আছে। তাহলে মানসম্পন্ন বাঁধের মাপ হলো : ভূপৃষ্ঠে চওড়া ৮৩ ফুট, ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১৩ ফুট এবং উপরে চওড়া ১৩ ফুট। ২০০৮-০৯ সালে বাঁধের উচ্চতা ছিলো গড়ে আট ফুট, যা জলোচ্ছ্বাস তো দূরের কথা স্বাভাবিক জোয়ারোচ্ছ্বাস প্রতিরোধেও সক্ষম নয়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু বিষয়। ষাটের দশকে যখন বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয় তখনকার উদ্দেশ্য ছিলো আবাদি জমিতে নোনাপানি ঢোকা বন্ধ করে কৃষির উৎপাদন বাড়ানো। অাশির দশকে উদ্দেশ্য আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি পূরণ করার উদ্দেশ্যে রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য নোনাপানির চিংড়িচাষে উদ্বুদ্ধ করা শুরু হলো। চিংড়ি রপ্তানিকারকদের নগদ ভর্তুকি দেয়ার জন্য ঋণ নিয়ে এলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা ভূমিহীন ও ক্ষুদ্রচাষিদের হত্যা-ধর্ষণের মাধ্যমে উৎখাত তো করলোই, নোনাপানির জন্য বাঁধ ফুটো করে ঢোকাতে লাগলো বিভিন্ন আকারের পাইপ। ২০০৮ সালে ৫০ কিমি বেড়িবাঁধে কমপক্ষে ৩৫০ জায়গায় ফুটো করা হয়েছিলো।

আর কেন-ই-বা ফুটো করবে না? চিংড়িতে নব্বই থেকে শূন্য দশক অবধি প্রতি এক টাকা বিনিয়োগে পাঁচ টাকা লভ্যাংশ পাওয়া যাচ্ছিলো। অপরদিকে বেড়িবাঁধের ক্ষতি করলে ১৯৫২ সালের বেড়িবাঁধ সংরক্ষণ আইনে জরিমানা মাত্র দু’শ টাকা বা এক মাসের জেল। নব্বই থেকে শূন্য দশকে এ জরিমানা নিতান্ত বালকও পরিশোধ করতে পারে। ফলে বেড়িবাঁধ কাটলে অভিযোগ করা হচ্ছিলো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে যার দায় নির্ধারণ করে প্রশাসন আর বাতিল করে দেয় আদালত। এসব কারণে ভেঙে পড়া ছাড়া বেড়িবাঁধগুলোর সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। জলবায়ু পরিবর্তন বা অন্য কোনো দৈব কারণ দেখিয়ে এ দায় থেকে পালানো যায় না। সরকারি কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা বা সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব না।

এখন প্রশ্ন হলো, এ অবস্থায় কী করা উচিৎ। বর্তমান পরিস্থিতে বেড়িবাঁধ ছাড়া সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূলে কোনো জনবসতি টিকে থাকতে পারবে না, এটা ধ্রুব সত্য। অন্যদিকে এই বিপুল জনগোষ্ঠী অন্য কোথাও স্থানান্তর করাও সরকারের জন্য প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। এসব জনগোষ্ঠী কয়েক শ’ বছরের চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছে নিজেদের সভ্যতা। তাই ইচ্ছে করলেও কাউকে বাস্তুভিটা থেকে তুলে দেয়া যাবে না। তাই মধ্যবর্তী উপায় খোঁজাই এখন সবথেকে উত্তম পথ।

সবার আগে দরকার উজান থেকে ভাটির দিকে একাধিক জোয়ারাধার বা টিআরএম চালু করা যাতে বিপুল পরিমাণ পলির একটা বড়ো অংশ আবাদি জমিতে নিয়ে যাওয়া যায়। এর ফলে আবাদি জমি যেমন উঁচু হবে তেমনি পার্শ্ববর্তী নদী ও খালগুলোর গভীরতা বাড়বে। এর আরো কয়েকটি সুবিধা পাওয়া যাবে : নৌ-যোগাযোগ ও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি তার মধ্যে অন্যতম।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন গ্রহণ করা হয়েছে। বেড়িবাঁধ সুরক্ষার প্রশ্নটিও এ আইনের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে বেড়িবাঁধের ক্ষতি করে দুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে দুই বছরের জেল বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় এ আইন বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। আইনটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করলে উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ দুর্যোগ-ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে।

বেড়িবাঁধ বিষয়ক কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারাধার তৈরি ও বাস্তবায়নের অর্থায়ন সংযুক্ত করা উচিৎ যাতে বেড়িবাঁধ ও জোয়ারাধার - এই দুটি বিষয় একীভূত হয়ে যায়।

জোয়ারাধার বাস্তবায়নের পর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বেড়িবাঁধ পুরোপুরি তুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে হাজার বছর ধরে চলে আসা ষষ্ঠমাসী বাঁধব্যবস্থা চালু করা উচিৎ। এ ব্যবস্থার আওতায় পয়লা জানুয়ারি থেকে তিরিশে জুন পর্যন্ত বেড়িবাঁধ থাকবে এবং পলি ঢোকানোর জন্য পয়লা জুলাইতে বেড়িবাঁধের সুবিধাজনক স্থানসমূহে কেটে দেয়া হবে।

উপকূলের সম্মুখভাগ, অর্থাৎ সরাসরি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে এমন জায়গা ছাড়া আর কোথাও নতুন বেড়িবাঁধ নয় - এ নীতির আলোকে যথোপযুক্ত উপায়ে গ্রাম, ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ উঁচু করতে হবে যাতে ভবিষ্যত ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারে।

প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস না করলে প্রকৃতিই আমাদেরকে দূরীভূত করে দিবে।