উদ্ভিদের বাঙলা নামের সঙ্কট

বাংলাদেশের উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার যার মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রজাতির সংখ্যা তিনশ’র মতো। এসব উদ্ভিদপ্রজাতির মধ্যে পাঁচ হাজারই আবৃতবীজ এবং চারটি অনাবৃতবীজ। আটটি উদ্ভিদ একান্তভাবেই বাংলাদেশের স্থানীয় প্রজাতি। এইসব উদ্ভিদের মধ্যে মোটামুটি আড়াই হাজার প্রজাতির বাঙলা নাম পাওয়া যায়। এসব বাঙলা নাম নিয়েও কতোগুলো সঙ্কট রয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা অনুসারে সমস্যাগুলো হলো :

১. একাধিক প্রজাতি (species) একই বাঙলা নামে পরিচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রজাতিগুলো একই গণ (genus)-এর অন্তর্গত। সেটা খুব বড়ো সমস্যা না। কিন্তু সমস্যা প্রবল হয়ে ওঠে যখন একাধিক গোত্রের (family) উদ্ভিদ একই বাঙলা নামে পরিচিত হয়। কোনোক্রমেই বাঙলা নাম দেখে প্রজাতি চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।

২. আবার একই প্রজাতির উদ্ভিদের একাধিক বাঙলা নাম, কখনও কখনও দশ-বারোটি নামও রয়েছে যার মধ্যে সর্বজন ব্যবহৃত নাম দুই বা তিনটি। এতগুলো নাম মনে রাখা কঠিন বিধায় স্থানীয় বাঙলা নাম শুনে প্রজাতি চিহ্নিত করা প্রায়াসম্ভব একটি কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. যেসব প্রজাতির নিজস্ব বাঙলা পাওয়া যায় না, সেগুলো চিহ্নিত করার জন্য ইংরেজি নাম ও বৈজ্ঞানিক নামের শরণাপন্ন হতে হয়। তাতে আরেক ধরনের সঙ্কট দেখা দেয় : এক বা একাধিক প্রজাতির বাঙলা নাম পাওয়া যায় এবং অপরাপর এক বা একাধিক প্রজাতির বাঙলা নাম পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাঙলা বা ইংরেজি নাম শুনে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৪. কোনো কোনো উদ্ভিদবিদ উদ্ভিদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক নাম বা ইংরেজি নামানুসারে একটি বাঙলা নামকরণ করে ফেলেন। কখনও কখনও সেসব নাম জুৎসই হয় বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হাস্যকরও হয়ে ওঠে। কখনও বা একই গণের অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে নামটির কোনো মিল থাকে না, কখনও ইংরেজি একটি শব্দ সরাসরি বাঙলায় লিখে দেয়ার কারণে নামটি মেকি দেখায়, আবার কখনও কোনো উদ্ভিদবিদ বা অন্য কারো নাম জুড়ে দেয়ার কারণে নামটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।

এ কারণে বাঙলায় পাওয়া যায় এমন উদ্ভিদের বাঙলা নামকরণ খুবই জরুরি একটি কাজ। একইসঙ্গে একটি মাননামও নির্ধারণ করা দরকার। এই নামকরণের ফলে আর কিছু না হোক, নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাঙলাদেশের উদ্ভিদের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা জন্মানো সম্ভব।

উদ্ভিদের বাঙলা নামকরণের প্রস্তাবনা 
--------------------------------------------
পথ দেখিয়ে দিয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় পাখি বিশারদ ইনাম আল হক। তিনি বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাখির বাঙলা নামকরণে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তা অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের নামকরণে একটি কার্যকর উদহারণ হতে পারে। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই উদ্ভিদের বাঙলা নামকরণের কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি :
  • উদ্ভিদের নামের ক্ষেত্রে প্রচলিত বাংলা বানানরীতি অনুসরণ করা। পূর্ববর্তী বানানরীতিতে লেখা নামগুলো রাখা যেতে পারে, তবে কাঙ্ক্ষিত বানান প্রথমে বসানো উচিৎ।
  • প্রথাগত ঐতিহ্য, লিখিত বা কথ্য সংস্কৃতি ও সাহিত্যে উল্লেখিত এবং উদ্ভিদবিদগণের দেয়া নামগুলো যথাযথভাবে থাকবে। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যাঁরা উদ্ভিদের নামোল্লেখ করেছেন : ইনাম আল হক, জীবনানন্দ দাশ, দ্বিজেন শর্মা, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এঁদের ভুল শনাক্তি নেই, তা নয়। ভুল যেটা সেটা ভুল হিশেবে নিয়ে সঠিক নামই লেখা উচিৎ।
  • বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামকরণ ভুল হলে সেই নামটি সবশেষে লিখে বন্ধনীর মধ্যে ব্যক্তির নাম দিতে হবে। যেমন : গুলিকদম, হলদু, কেলিকদম [বিভূতিভূষণ] 
  • অপেক্ষাকৃত সহজ, সাধারণ ও বহুল ব্যবহৃত নামটি উদ্ভিদের বাঙলা নামের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। বাঙলা নাম হিশেবে সর্বাগ্রে প্রকৃত বাঙলা শব্দ গৃহীত হবে।
  • মানসম্মত বাঙলা নাম পাওয়া না গেলে যে কোনো অঞ্চলের ‘স্থানীয় বাঙলা নাম’ গ্রহণ করা হবে। একাধিক স্থানীয় বাঙলা নাম থাকলে শ্রুতিমধুর ও যুৎসই বাঙলা নামটি মান-নাম হিশেবে গৃহীত হবে।
  • কোনো ধরনের বাঙলা নাম পাওয়া গেলে কোনো নতুন নামকরণের চেষ্টা করা যাবে না। এ ধরনের কাজে শ্রম ও সময় ক্ষয়ের তুলনায় খুব সামান্যই প্রাপ্তি হয়।
  • কোনো বাঙলা নাম না পাওয়া গেলে প্রথমে সংস্কৃতজাত ও পরে প্রাকৃত ভাষা থেকে গৃহীত নাম গ্রহণ করা যাবে।
  • ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আরবি ইত্যাদি ভাষার অপ্রচলিত নাম পরিত্যাগ করার চেষ্টা করতে হবে।
  • একান্তই বাধ্য হয়ে বিদেশি নাম গ্রহণ করতে হলে বিদেশি নামগুলোর মধ্যে যেটি সহজ ও সাধারণে ব্যবহারযোগ্য সেটি গ্রহণ করা হবে।
  • যেসব উদ্ভিদের কোনো বাঙলা নাম নেই তাদের জন্য নতুন বাঙলা নাম প্রবর্তন করা যেতে পারে। তবে এটি সর্বশেষ উপায়। যদি কোনো উপমহাদেশীয় ভাষায় যুৎসই নাম পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রেও নতুন নামকরণের কোনো আবশ্যকতা নেই।
  • উদ্ভিদটির ইংরেজি নাম পরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট গণের সমগণের ও সমদর্শীয় অন্য উদ্ভিদের নামের পূর্বে বা পরে একটি শব্দ জুড়ে দেয়া যেতে পারে। যেমন : ফুল ফোটার সময়কাল (সন্ধ্যা, প্রভাত, দুপুর); উদ্ভিদটির চরিত্র (লতা, ঝোপা); প্রাপ্তিস্থান (জংলি, বুনো); উদ্ভিদটির আকৃতি (ছোট, বড়ো); ফুল ও পাতার রঙ (সাদা, কালো, হলদে, লাল, সবুজ); ফুলের বৃন্ত (অবৃতি, বৃন্ত) ইত্যাদি যুক্ত করে উদ্ভিদের নামকরণ করা যেতে পারে।
  • উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নামে ‘ইন্ডিকা’ বা ‘ইন্ডিকাস’ থাকলে বাঙলা নামে সংশ্লিষ্ট গণের (genus) সমদর্শীয় উদ্ভিদের বাঙলা নামের সঙ্গে ‘দেশি’ যুক্ত করা যেতে পারে। 
  • উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নামে ‘বেঙ্গালনেসিস’ থাকলে বাঙলা নামে নামে সংশ্লিষ্ট গণের (genus) সমদর্শীয় উদ্ভিদের বাঙলা নামের সঙ্গে ‘বাঙলা’ বা ‘বঙ্গ’ যুক্ত করা যেতে পারে। 
  • উদ্ভিদের বাঙলা নামে বিশেষণসূচক ‘বাংলাদেশি’ বা ‘ভারতীয়’ শব্দ যুক্ত করা যাবে না। ভারতীয়-এর বদলে ‘দেশি' শব্দ প্রতিস্থাপিত হবে। একইভাবে, মাদাগাস্কারীয়, ইন্দোনেশীয়-এরকম দেশভিত্তিক শব্দের ইংরেজি সমনাম খুঁজে বাঙলা করা দরকার। তবে উদ্ভিদের প্রচলিত স্থানসূচক নাম যেমন ‘আসাম লতা’, ‘জার্মানি লতা’, ‘বিলাতি গাব’, ‘চিনাবাদাম’ বা ‘জাপানি চা’ চলবে। 
  • কোনো নতুন বাঙলা নাম গৃহীত হলে, যিনি নামকরণ করেছেন তাঁর স্বীকৃতি দেয়া হবে এভাবে : (উদ্ভিদের বাঙলা নাম লিখুন) নামকরণ করেছেন (পরিচয় লিখুন : নিসর্গী/কবি/সাহিত্যিক/পরিবেশকর্মী) (নামকরণকারীর নাম)। 
  • সম্ভব হলে নামকরণকারীর পরিচয় পাওয়া যায় এমন কোনো ওয়েবপেইজ বা সাইটের লিংক সংযুক্ত করা হবে।
  • বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, উদ্ভিদবিদ, নিসর্গী, পরিবেশকর্মীর কৃত উদ্ভিদের নামের শেষে দ্বিতীয় বন্ধনীর মধ্যে নামকরণকারীর নাম লিখতে হবে এবং তথ্যসূত্রটি তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখতে হবে।