জীবনানন্দ-চর্চার পত্রিকা ‘জীবনানন্দ’



‘মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি’ খাওয়া নিন্দুকগন যখন তাঁর কবিতাও খুঁটে খুঁটে অশ্লীলতা বের করছেন আর অশ্লীলতর ব্যক্তি-আক্রমণ করে চলেছেন তখন যন্ত্রণাদগ্ধ মনে তিনি সুহৃদ ভূমেন্দ্র গুহকে বলেছিলেন, “ওঁরা যখন থাকবেন না, আমিও থাকব না, এবং আপনারাও নির্ঘাৎ বুড়ো হয়ে যাবেন, তখন হয়তো ব্যাপারটার এক রকম যাথার্থ্য নির্ণীত হবে, হয়তো হবে না...[১]” 
এবং কী আশ্চর্য, জীবনানন্দের শারীরিক মৃত্যুর প্রায় ছয় যুগ পরও বাঙলা সাহিত্যের আধুনিক পাঁচ দেবতার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত উজ্জ্বলতম! অনুভবের গভীরতার দিক দিয়ে বিচার করলে বাঙলা সাহিত্যে তাঁর কাব্যের কোনো তুলনা নেই [২]। সময়ের বিবর্তনে তাঁর নামের সঙ্গে নানা অভিধা যোগ হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি পলায়নবাদি, শুদ্ধতম, নির্জনতম, প্রতীতিবাদি, নিশ্চেতনার, বিষন্নতার, বিরহের, মায়াবাস্তবতার, পরাবাস্তবতার বা প্রকৃতির কবি [৩] [৪] [৫] [৬] যদিও স্বয়ং জীবনানন্দ নিজ-কবিতার এমন সংজ্ঞায়নের বিপক্ষেই বলেছেন [৭]। 
তবে জনতা বা পাঠক কতদিন লেখককে মনে রাখবে সেটি হয়তো তাঁর অবচেতনে সচল ছিল সব সময়। এ কারণেই ‘নভেলের পাণ্ডুলিপি’ (সফলতা নিষ্ফলতা) উপন্যাসে প্লেটো-সক্রেটিসতুল্য ‘দশ হাজার বছর’ টিকে থাকার জন্য স্কেচ করার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বাণেশ্বর ও নিখিলের কথোপকথনে দেখতে পাই, “দশ হাজার বছর পরে লোকে বুঝতে পারবে, আপনি প্লেটো না; না, অতীন্দ্র প্লেটো; না, দিলীপবাবু প্লেটো... [৮]”। জীবনানন্দ কি তখনই সমসাময়িক সবাইকে নস্যাৎ করে দেন? নাকি চ্যালেঞ্জ করেন? 
এ যেন একই মন্দিরে শুক্রাচার্য আর ইন্দ্রের পুজো। মহাকালের ব্যাপ্তিটা যদি মানবজীবনের সাপেক্ষে সঙ্কুচিত করা যায় তবে দেখতে পাবো বাণেশ্বর (বুদ্ধদেব বসু) বা তাঁর সমসাময়িক সবাই জন-পরিসরে ক্রমশ ম্লান হয়ে গেছেন আর ব্যাস্তানুপাতিক হারে চর্চিত হচ্ছেন শারীরীক-জীবনে সবথেকে ম্লান মানুষ - জীবনানন্দ দাশ। 
ইতোমধ্যে তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে রচনা হয়েছে শতাধিক গ্রন্থ। শুদ্ধাশুদ্ধ মিলিয়ে কয়েকটি (অন্তত পাঁচটি) উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে। আবারও ‘নভেলের পাণ্ডুলিপি’র সংলাপ মনে রেখে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন যে চণ্ডীদাসদের মতো তাঁর জীবনের ভরা বেদনা নিয়ে তিনি লিখবেন আর সেই রচনাবলি চর্চা করেই ভবিষ্যতে আসবে ডিগ্রি আর অর্থকড়ি, পসার [৯]? 
কুড়ি পঞ্চম দশকের ‘ময়ূখ’ থেকে শুরু করে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত বহু পত্রিকা-সাময়িকীর কথা মনে পড়ে জীবনানন্দের কথা উঠলেই। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বহু বহু তরুণ সাহিত্যকর্মী ও সাহিত্যিকের জীবনের বড় একটা সময় কেটে গেছে জীবনানন্দের নেশাঘোরে। তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেই হয়তো আরেকটি উদ্যোগ মাসউদ আহমাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকা ‘জীবনানন্দ’। 
অন্তর্মুখী হবার কারণে জীবনানন্দ দাশের জীবনে দৃশ্যমান ঘটনার তুলনায় অদৃশ্য ঘটনার সংখ্যা বিপুল, অবশ্য যদি আমরা ব্যক্তিমনের প্রতিক্রিয়া ও ইচ্ছাগুলোকে ঘটনা হিশেবে গণ্য করি। এছাড়া জীবনভর অস্পর্শী একাকিত্বের কারণে সব ঘটনার পরম্পরাও সব সময় জানা গেছে, এমন নয়। আজও আমি জানতে পারিনি, বাগেরহাটের আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কলেজে তিনি কোন মাস থেকে কোন মাস পর্যন্ত চাকরি করেছেন। সেই সময়ের কোনো নথি সরকারি পিসি কলেজে এখন আর নেই। সেখান থেকে কবে গিয়েছিলেন আসামের ডিব্রুগড়ে? শোভনার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কাকীমা সরযূবালার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। কাকা অতুলানন্দ দাশকেও পছন্দ করতেন না তিনি [১০]। সেই সম্পর্কাবনতির কারণ কী? কবে তিনি চূড়ান্তভাবে ছেড়ে এসেছিলেন বরিশাল? কেন তখন নিয়ে আসেননি মা কুসুমকুমারী দাশ ও নিজের সব পাণ্ডুলিপি? কোথায় গেল সেগুলো? তারপর কেন ১৯৫৩ সালে এসে আবারও আকুতি জানাচ্ছেন সেইসব পাণ্ডুলিপির জন্য [১১]? 
এসবের উত্তর যাঁরা দিতে পারেন তাঁদের মধ্যে সবথেকে সঠিক মানুষ সম্ভবত গৌতম মিত্র। দুই যুগ ধরে যিনি শুধু জীবনানন্দ দাশের জীবন ও রচনার রহস্য উন্মোচনে নিবেদিত, তাঁর চেয়ে যোগ্য মানুষ সত্যিই বাঙলায় বিরল। ‘জীবনানন্দ’ পত্রিকাটি শুরু হয়েছে তাঁর লেখা ‘চল্লিশ লক্ষ শব্দে মুদ্রাদোষ’ নামক প্রবন্ধ দিয়ে। জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে এমন এক নির্যাস আমাদের সামনে তিনি হাজির করেছেন যার অনেক তথ্যই হজম করার জন্য এখনও বাঙালি প্রস্তুত নয়। আমাদের প্রচলিত ধারণা, ১৯৩০-১৯৩৫ মেয়াদে জীবনানন্দ কোথাও একটা চাকরি পাননি। অপরিসীম দারিদ্র্য আর মনোকষ্টে লিখেছেন কবিতা। তিরিশের দশকে একজন ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ মানুষ চাকরি পাবেন না, এটা বিশ্বাস করা কষ্ট। গৌতম মিত্র তাঁর গবেষণার রায় জানাচ্ছেন যে, জীবনানন্দ এ সময় চাকরি করতেই চাননি। জীবনানন্দ এমনই। 
আজ এই ২০২০ সালে আমরা জীবনানন্দের কয়েকটি জীবনীগ্রন্থ সংগ্রহ করতে পারি। কোনোটা সালভিত্তিক ঘটনাক্রমের বিবরণ আবার কোনোটা বর্ণনা-বিশ্লেষণাত্মক। সর্বপ্রথম জীবনানন্দ দাশের একটি প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ ‘জীবনানন্দ দাশ’ লেখেন প্রখ্যাত গবেষক প্রভাতকুমার দাস। এখন পর্যন্ত এটি বাঙলায় জীবনানন্দ-চর্চার অন্যতম আকরগ্রন্থ [১২]। গত কুড়ি বছরে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে গ্রন্থটির তিনটি সংস্করণ বেরিয়ে গেছে। এছাড়াও প্রভাতকুমার দাস সম্পাদনা করেছেন জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র বিষয়ক গ্রন্থ ‘পত্রালাপ : জীবনানন্দ দাশ’। জীবনানন্দ দাশের জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে তিনি প্রতিষ্ঠানসম। তাঁর সাক্ষাৎকার ‘জীবনানন্দ’ পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। 
পত্রিকাটিতে প্রকাশিত আরেকটি সাক্ষাৎকার ‘সোনালি ডানার চিল’র লেখক সুরঞ্জন প্রামাণিকের। জীবনানন্দ দাশের জীবনভিত্তিক উপন্যাসগুলোর অন্যতম ‘সোনালি ডানার চিল [১৩]। অন্য উপন্যাসগুলোর তুলনায় সোনালি ডানার চিল নিঃসন্দেহে উজ্জ্বলতর-প্রাণবন্ত, জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়। সুরঞ্জন প্রামাণিকের তথ্য সংগ্রহের কৌশল, প্রক্রিয়া ও নিবেদন নতুন লেখকদের জন্য পাথেয় হয়ে উঠতে পারে। 
জীবনানন্দ পত্রিকার শেষ সাক্ষাৎকারটি অশোকানন্দ দাশের পুত্র অমিতানন্দ দাশ যিনি বাবার মৃত্যুর পরে জীবনানন্দের পারিবারিক তথ্যাবলির একমাত্র উৎস। 
পত্রিকাটিতে এছাড়া জীবনানন্দ ও জীবনানন্দ-চর্চা বিষয়ে সুবোধ সরকার, জয় গোস্বামী, সাদাত হোসাইন, দেবাশীষ ঘড়াই, আমীন আল রশীদ, সুমিতা চক্রবর্তী, মো. মেহেদী হাসান, সিরাজ সালেকীনের, হামীম কামরুল হক, হানযালা হান, সৈয়দ তৌফিক জুহরী, মিরাজুল আলম, জাহিদ আকবর ও কিং সউদের তথ্যবহুল লেখা রয়েছে। 
পত্রিকাটির লিটল ম্যাগাজিন রূপ ধরে রাখতেই সম্ভবত যুক্ত হয়েছে কয়েকজন নবীন-প্রবীন কবি-লেখকের গল্প-কবিতা। জীবনানন্দ দাশের জীবনের সামান্য সূত্র, ঘটনা বা চরিত্রের নাম অবলম্বন করে গল্প লেখার যেমন সুবিধের দিক আছে, তেমনি আছে অসুবিধেরও। অগ্রসর পাঠকেরা ‘অসুবিধেগুলো’ দ্রুত দেখে ফেলেন, এই ঝুঁকি নিতে পারলে ও পথ মন্দ না। 
পত্রিকাটার প্রথম সংখ্যাটা আমি হাতে পাইনি, কিন্তু দ্বিতীয় সংখ্যাটা এমন নজরকাড়া যে তা সম্পাদকের রুচি ও জীবনশক্তির নজির তৈরি করেছে। ঝকঝকে মুদ্রণ, সুন্দর বাঁধাই ও মানানসই আকারের কারণে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সহজ। 
ইতোপূর্বে জীবনানন্দ দাশকে কেন্দ্র করে বরিশাল থেকে একই নামে আরেকটি সাময়িকী প্রকাশিত হত বলে জানি যার সম্পাদক কবি হেনরী স্বপন। নামের এই পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব হলে ভালো লাগতো।

প্রচ্ছদের পরের পৃষ্ঠাতেই চট্টগ্রাম টিভি স্টেশনে জীবনানন্দের ছবির সামনে দাঁড়ানো একজন জীবনানন্দ-অনুরাগী সমকালীন কবির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশে জীবনানন্দ-প্রেম ও চর্চা বাড়ছে’ - এমন ক্যাপশনের সঙ্গে ছবিটি ব্যবহৃত হলেও পত্রিকার সৌন্দর্য্যহানি হয়েছে বলে মনে হয়।

সংগৃহীত লেখাগুলোর সূত্র বিস্তারিত লেখার অনুরোধ করছি তাতে অনুসন্ধিৎসু পাঠক মূল রচনাটি খোঁজার প্রয়াস পেতে পারেন। 
জীবনানন্দ-চর্চার ধারাবাহিকতার আরেকটি উদ্যোগ ‘জীবনানন্দ’ - বেঁচে থাকুক সগৌরবে, ক্রমোন্নতির ধারায়, এ কামনা রইলো। 
তথ্যসূত্র 
------------- 
[১] গুহ, ভূমেন্দ্র. ১৯৯৯. আলেখ্য : জীবনানন্দ. আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা : জানুয়ারি ১৯৯৯ 
[২] মিত্র, অশোক. ২০১৫. আমাদের কবি. উদ্ধৃত, বিমূঢ় বিস্ময় : জীবনানন্দ দাশ. সম্পাদনা : রকিবুল হাসান, তাহা ইয়াসিন ও শামস্ আল্দীন. সমাচার, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
[৩] খান, আকবর আলি. ২০১৪. চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’. প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৪;
[৪] গুহ, ভূমেন্দ্র. ১৯৯৯. প্রাগুক্ত
[৫] মজুমদার, জহর সেন. ২০১৫. জীবনানন্দের পরাবাস্তব. উদ্ধৃত, বিমূঢ় বিস্ময় : জীবনানন্দ দাশ. প্রাগুক্ত
[৬] মাহমুদ, আনু. ২০১২. জীবনানন্দ একটি প্রতিষ্ঠান. জ্ঞান বিতরণী, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
[৭] দাশ, জীবনানন্দ. ১৯৫৪. জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা. নাভানা, কলকাতা : মে ১৯৫৪. (ভূমিকা) 
[৮] দাশ, জীবনানন্দ. ২০১৮. নভেলের পাণ্ডুলিপি (সম্পাদনা : গৌতম মিত্র). ঋত প্রকাশন, কলকাতা : জুলাই ২০১৮ 
[৯] দাশ, জীবনানন্দ. ২০১৮. প্রাগুক্ত 
[১০] মিত্র, গৌতম. ২০১৯. পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি : জীবনানন্দের খোঁজে (দ্বিতীয় সংস্করণ, মার্চ ২০১৯). ঋত প্রকাশন, কলকাতা : জানুয়ারি ২০১৯ 
[১১] রাহমান, শামসুর. ২০০১. “অসীমের সৈকতে”. উদ্ধৃত : জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ. দ্বিতীয় মুদ্রণ : ২০০৭ (সম্পা. সৈয়দ, আবদুল মান্নান ও হাসনাত, আবুল). অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০০১ 
[১২] দাস, প্রভাতকুমার. ১৯৯৯. জীবনানন্দ দাশ. তৃতীয় সংস্করণ (আগস্ট ২০১৩). পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ 
[১৩] প্রামাণিক, সুরঞ্জন. ২০০৯. সোনালি ডানার চিল. উবুদশ, কলকাতা : ডিসেম্বর ২০০৯