বাঙলা নববর্ষ কে প্রবর্তন করেছেন?

এ লেখার শুরুতে একটা ডিসক্লেইমার বা দায়-ঘোষণা দেয়া দরকার। এক. আমি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বা কোনো ধর্মাবলম্বী বা কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পক্ষেও না বিপক্ষেও না। কেউ যথাযথ ন্যায়বিচার না পেলে তার পক্ষে। একবার এক বন্ধু বলেছিলেন, “যখন শাসকগোষ্ঠী ও নাগরিকের মধ্যে বিবাদ হয় তখন আমি নাগরিকের পক্ষে। যখন মূলধারার নাগরিক ও আদিবাসীদের মধ্যে বিবাদ হয় তখন আমি আদিবাসীদের পক্ষে। যখন আদিবাসী ও বাঘের মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন আমি বাঘের পক্ষে; আর যখন বাঘ ও বন বিড়ালের মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন আমি বন বিড়ালের পক্ষে।” তাই কে রাজা আর কে প্রজা সেটা বিবেচনা না করে বরং ইতিহাস কাকে নিষ্পেষিত করেছে সেটা দেখাই আমার জন্য জরুরি। 

দুই. আমি কোনো ইতিহাসবিদ, জ্যোতির্বিদ বা নৃতত্ত্ববিদ নই যে, সব প্রশ্নের উত্তর জানবো। কোন এক দার্শনিক বলেছিলেন, প্রশ্নের মধ্যে কোনো ভুল থাকে না, ভুল থাকে উত্তরের মধ্যে। আমার তোলা প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনো নৃতাত্ত্বিক বা ইতিহাসবিদ দিবেন। কিন্তু সন্তুষ্ট হবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত প্রশ্ন করার অধিকার আমার আছে। 

বাঙলা নববর্ষ প্রবর্তন করেছিলেন সম্রাট আকবর, এমন ধারণা মোটামুটি সব বাঙালিই পোষণ করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবেও আগপাশতলা না ভেবেই সেটা প্রচার করা হয়, আবার গবেষকগণও সেটাই নানানভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে থাকেন। বাঙলা সাল গণনায় আকবরের অবদান রয়েছে সেটা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই অবদান কতখানি ও কোন পর্যায়ে সেটা কিন্তু দেখার দরকার আছে। এটুকু দেখার জন্য দরকার ছিলো এমন ইতিহাসবিদের যিনি নৃতত্ত্বও খুঁড়ে দেখতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশই, হুমায়ুন আজাদ যাঁদের বলেছিলেন ‘নজরুল গবেষক নন, নজরুলের মাজারের খাদেম’ অথবা ‘রবীন্দ্র গবেষক নন, রবীন্দ্রনাথের অন্ধ অনুসারী’, তাদের মতো। হয়তো কেউ কেউ সত্যিকারের গবেষণা করেছেন, কিন্তু সেটি সাধারণ্যে প্রচারিত হয়নি, অথবা প্রচারিত হতে দেয়া হয়নি। 

বাঙলা নববর্ষ পালিত হয় ১৪ বা ১৫ এপ্রিল (বাংলা একাডেমি বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালন স্থির করে দিলেও পশ্চিমবাংলায়, ঐতিহ্যগত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, কোনো বছর ১৪ এপ্রিল, আবার কোনো বছর ১৫ এপ্রিল নববর্ষ পালিত হয়)। আসুন, একটু দেখে নেই কোন কোন জাতিগোষ্ঠী ১৩, ১৪ বা ১৫ এপ্রিলে নববর্ষ পালন করে। 
  1. অসমী নববর্ষ (রঙ্গালি বিহু) : ১৪ বা ১৫ এপ্রিল 
  2. ওড়িয়া নববর্ষ (বিষুব সংক্রান্তি) : ১৪ এপ্রিল 
  3. কম্বোডিয়ান নববর্ষ (চাউল চাম) : ১৪, ১৫ ও ১৬ এপ্রিল 
  4. চাকমা নববর্ষ (বিজু) : ১৪ এপ্রিল
  5. ডোগরা নববর্ষ : ১৪-১৫ এপ্রিল 
  6. তামিল নববর্ষ (পুথান্ডু) : ১৩, ১৪ বা ১৫ এপ্রিল 
  7. তুলুয়ান নববর্ষ (বিসু) : ১৪ বা ১৫ এপ্রিল 
  8. ত্রিপুরা নববর্ষ (বৈসুক) : ১৪ এপ্রিল 
  9. থাই নববর্ষ (সংক্রান) : ১৩, ১৪, ১৫ বা ১৬ এপ্রিল 
  10. দাই নববর্ষ, চীন : ১৩, ১৪ বা ১৫ এপ্রিল 
  11. দক্ষিণী তামিল নববর্ষ (ভিসু) : ১৪ এপ্রিল 
  12. নেপালি নববর্ষ (বিক্রম সম্বত) : ১৩-১৪ এপ্রিল 
  13. বার্মা নববর্ষ (থিঙ্গিয়ান) : ১৩, ১৪, ১৫ বা ১৬ এপ্রিল 
  14. মণিপুরী নববর্ষ (চেইরুবা) : ১৪ এপ্রিল 
  15. মরিশাসীয় নববর্ষ (পুথান্ডু) : ১৪ এপ্রিল 
  16. মালায়লী নববর্ষ (ভিশু) : ১৩, ১৪ বা ১৫ এপ্রিল 
  17. মালয়শিয়ান নববর্ষ (পুথান্ডু) : ১৪ এপ্রিল 
  18. মৈথিলী নববর্ষ (জুড়ে শীতল) : ১৪ এপ্রিল 
  19. লাও নববর্ষ (পিমাই) : ১৩, ১৪, ১৫ বা ১৬ এপ্রিল 
  20. শিখ নববর্ষ (বৈশাখী) : ১৪ এপ্রিল 
  21. সিঙ্গাপুরি নববর্ষ (পুথান্ডু) : ১৪ এপ্রিল 
  22. সিংহলী নববর্ষ (আলুথ আভুরুথু) : ১৪ এপ্রিল 

লক্ষ্য করুন, ওড়িয়া বিষুব, অসমীয় বিহু, দক্ষিণ তামিলের ভিসু, তুলুয়ান বিসু, মালায়লী ভিশু আর চাকমাদের বিজুর মধ্যে কী অদ্ভুত মিল! চাকমা আদিবাসী ও তুলুয়ান আদিবাসীদের দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিমি। একটি জনগোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড, অপরটি দ্রাবিড়িয়ান। কিন্তু দু’জনের নববর্ষের নাম এক, তারিখও এক। আবার তামিল, মরিশাস, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর - এই সব জায়গাতেই নববর্ষের নাম ও তারিখ একই : পুথান্ডু, ১৪ এপ্রিল। কী করে হলো? সম্রাট আকবর নিশ্চয়ই করেননি! 

৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি বিস্তৃত সঙ্গম যুগে (মাদুরাই শহরে শিক্ষাগুরুদের সম্মিলনী। প্রায় আড়াই হাজার কবি, সাহিত্যিক, জ্যোতির্বিদসহ জ্ঞানী ব্যক্তিদের কয়েক শ’ বছর টিকে থাকা শিক্ষাগুরুদের সভা) লিখিত সর্বপ্রাচীন তামিল কবিতাবলিতে তামিল নববর্ষের কথা পাওয়া যায়। এসব কবিতায় মধ্য এপ্রিলে ১২টি রাশি পূর্ণ হবার পর নববর্ষ পালনের কথা বলা হয়েছে। তামিলদের পুথান্ডুতে মেলাও হয়।

৪র্থ শতক থেকে ৫ম শতকের মধ্যে লিখিত সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারতীয় বর্ষপঞ্জিসমূহ গড়ে উঠেছে। সূর্য সিদ্ধান্তের সবথেকে ভালো বিবরণ পাওয়া যায় বরাহ মিহিরের লেখা বৃহৎ সংহিতায়। এ বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করেই গড়ে উঠেছে মৈথিলী বর্ষপঞ্জি। 

বিশ্বাস করা হয় যে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৭ সালে রাজা বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত ও উজ্জয়নী থেকে বিতাড়িত করেন এবং সে বছর থেকে বিক্রম সম্বত গণনা করা হয়। কিন্তু গবেষকগণ জানাচ্ছেন যে ৮৪২ সালে বিক্রম বর্ষ গণনার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায়। বিক্রম সম্বত অনুসরণ করেই নেপালি নববর্ষ পালিত হয়। 

অপরদিকে সিংহলী নববর্ষ আজও নির্ধারণ করে থাকেন জ্যোতির্বিদগণ। অসমীয় বিহু পালিত হয় সর্বোচ্চ ১৪০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। নানকশাহী বর্ষপঞ্জি গণনা শুরু হয় গুরু নানকশাহের জন্মসাল ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। 

সিংহলী বর্ষপঞ্জী অনুসারে সূর্য যখন মীন রাশি থেকে মেষ রাশিতে যায় তখনই নতুন বছর ঘোষিত হয়। ধারণা করা হয় যে এটাই ভারতীয় ও পূর্ব এশীয় নববর্ষ গণনার সবথেকে প্রামাণ্য উদাহরণ। 

এইসব বর্ষপঞ্জি যখন অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে তখন সম্রাট আকবর বাঙলা সাল গণনা শুরু করেন ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। আকবরকে বলা হয় বাঙলা সালের প্রবর্তক। সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশ বাদ দিয়ে কেন আকবর শুধুমাত্র বাঙলা সাল প্রবর্তন করতে গেলেন, সে প্রশ্নের উত্তরও অজানা।

মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, চীনের কিছু অংশ ও মৌরিতাসেও একই সময়ে নববর্ষ পালিত হয়। সেসব জায়গায় তো আকবরের রাজত্ব ছিলো না। তারা কী করে জানলো যে ১৪-১৫ এপ্রিলই নববর্ষ হবে? বোঝা যাচ্ছে যে, এ অঞ্চলের প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা খুবই শক্তিশালী ছিলো 

তাহলে আকবর শুধু হিজরি সাল গণনা বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশীয় সাল গ্রহণ করেছিলেন, নাকি আরো সব জ্যোতির্বিদ্যার জারিজুরি খাটিয়ে তৈরি করেছিলেন নতুন বর্ষপঞ্জি? এ প্রশ্ন রয়ে যায় পিপাসুদের মনে।