লঞ্চ আর নদীর কথা

বাইশ বছর পর। আঙ্গুরবালা, এই খুলনা বিআইডাব্ল্যুটিএ লঞ্চঘাটে এখন দাঁড়ানো গুটিকয়েক লঞ্চ। পশ্চিমাদের ভাষায়, ফেরি। সবগুলো দুইতলা-তিনতলা, ইস্পাতের শরীর। একটার গায়ে লেখা ‘মেসার্স হালিম অ্যান্ড কোং'। আমাদের ছোটবেলায়, মানে আশির দশকেও, হালিম অ্যান্ড কোং-এর লঞ্চ ছিলো; কী অদ্ভুত নাম ছিলো সেগুলোর : এমএল সাফিনায়ে বাংলা, প্রাইড অব পেড়িখালী, ওয়াটার কিং-১ ইত্যাদি। কিন্তু বেশিরভাগ ছিলো কাঠের দেহ। এখন আর কাঠের লঞ্চ দেখা যায় না মনে হয়। সম্ভবত কাঠের দাম বেড়েছে আর লোকেরও তিন-চারতলা লঞ্চ বানাবার মুরোদ হয়েছে।

সেই ছোট্টবেলায়, প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসরুম থেকে এক দৌড়ে সামনের মাঠটাতে এসে দেখতাম কী প্রবল প্রতাপে একটা যন্ত্রশকট নদীর স্রোত ঠেলে গলুইয়ে ফিনকি দিয়ে পানি ছিটিয়ে, নদীর বুক চিরে সশব্দে ছুটে আসছে কাউকে তোয়াক্কা না করে। যেন অপ্রতিরোধ্য ভীম, যেন অর্জুনের তীর। আমরা তার শক্তি আর অবিচল লক্ষ্যমুখে চলার দাঢ্যতায় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইতাম। লঞ্চটা যেন পৌরাণিক প্রবল পুরুষ, দুর্মর।

নদীটার নাম ছিলো ভদ্রা। খুলনা থেকে রূপসা, ভৈরব, কাজীবাছা (কাঁচিকাটা), পশুর, শোলমারি পার হয়ে তবেই ভদ্রা। ভদ্রার পারের ছোট্ট গ্রামটিতে লঞ্চঘাট। ঘাটে পন্টুন বা অন্য কোনো অবকাঠামো নেই। পলিকাদাময় নদীর পাড়ে সজোরে এসে লঞ্চটি ভেড়ে। আর তার গলুইটা যেভাবে পলিকাদা কেটে ঢুকে যায় তা দেখে মনে হয় যেন ছুরি ঢুকে যাচ্ছে মাখনের ভেতরে। পরম বিস্ময়ে আমরা তা দেখি। প্রতিদিন দুবার, সকাল দশটায় খুলনা থেকে পাইকগাছার দিকে আর দুপুর দুটোয় পাইকগাছা থেকে খুলনার দিকের লঞ্চ এলে আমরা কয়েকটি বোকা ছেলে লঞ্চ আসা-যাওয়া দেখেই মুগ্ধ হই।

তারপর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পার হয়ে - এইসব নদী-খাল-বিল ছেড়ে, ট্যাংরা-পারসে-ভাঙান-কাইন-মাগুরের মায়া ত্যাগ করে ইটকাঠের শহরে এসে পড়লাম একদিন। উচ্চশিক্ষার দ্বিতীয় বছরে পরিকল্পনা হলো দল বেঁধে সুন্দরবন যাওয়া হবে শিক্ষাসফরে। শিক্ষাসফর তো নয়, আসলে এক দীর্ঘায়িত বনভোজন। আড়াই শ’ বিচ্ছুর বিশাল দঙ্গল। দক্ষিণের নোনাগন্ধী গাঁয়ের ছেলে বলেই হয়তো লঞ্চ নির্বাচন করার দায়িত্ব পেলাম কয়েক বন্ধুর সাথে, খানিকটা চন্দ্রবিন্দুর মতো। কোন লঞ্চে যাচ্ছি, সেটা দেখতেই এই বিআইডাব্ল্যুটিএ লঞ্চঘাটে এসেছিলাম। তখনই দেখলাম লঞ্চটাকে।

এমভি ওয়াটার কিং-৭। ১৯৯৬ সালের শীতের সকালে এই লঞ্চে করেই যাত্রা করেছিলাম সুন্দরবনপানে। আজ ২২ বছর পরে আবার উঠলাম লঞ্চটাতে। কয়রা যাবো বলে। মোটামুটি মানের একটি কেবিন পেয়েছি। বিদ্যুৎ আছে সারারাত। ল্যাপটপটা চালানো যাচ্ছে। হুকুম দিলেই চা-বিস্কিট আসছে। আর কী চাই!

লঞ্চের কথা মনে পড়লে হুড়মুড় করে মনে পড়ে খুলনা থেকে বাগেরহাট হয়ে দড়াটানা, ঘষিয়াখালী, পানগুছি, বলেশ্বর, কচা পাড়ি দেবার কথা। খুলনা থেকে গভীর রাতে যাত্রা করা স্টিমার ‘গাজী রকেট’-এর কথা। গাজী, শহীদ বেলায়েত, টার্ন, মধুমতি - কতো কতো স্টিমার গাম্ভীর্য আর আলস্যভরা সম্ভ্রম নিয়ে চলতো বাংলাদেশের নদীগুলোতে। এই এলানো সৌন্দর্য্য তোমাদের বাস-ট্রেন-বিমানে কই?

বাংলাদেশের নদীগুলো মেরে ফেলে তোমাদের বাণিজ্য হয়েছে বটে, মানুষের জীবন থেকে যে সৌন্দর্য্য কেড়ে নিয়েছো তা কি আর পরের প্রজন্মকে ফেরত দিতে পারবে, আঙ্গুরবালা? তোমার নয়নজুলিকে?