কলমি ও ফর্সক্যাল

আঙ্গুরবালা, কতো রকমের যে কলমি আছে বাঙলা মুল্লুকে! উদ্ভিদবিদেরা বলছেন চৌত্রিশ প্রকার! হলকলমি (Ipomoea alba L.), কলমিশাক বা কলমিলতা (Ipomoea aquatica Forssk.), কূলকলমি (Ipomoea cairica (L.) Sweet), দুই রকমের ঢোলকলমি (Ipomoea carnea Jacq. Ipomoea fistulosa Mart. ex Choisy), কুড়াকলমি (Ipomoea obscura (L.) Ker Gawl.), সাগরকলমি (Ipomoea pes-caprae (L.) R. Br.), ইন্দুরকানি কলমি (Ipomoea tiliacea (Willd.) Choisy), আরো একটা কলমিলতা বা কলমিশাক (Ipomoea Wetlanda Forssk.), সাদাকলমি (Merremia umbellata (L.) Hallier f.), দিনকলমি (Operculina turpethum (L.) Silva Manso)। আরো আছে কিন্তু চৌত্রিশটা নাম মনে রাখা তো আমার মতো হাদাছাত্রের কাজ না! তুহিন আবার বলে যে, ইপোমিয়া অ্যাক্যুইটিকারও নাকি দুটো জাত বা উপপ্রজাতি আছে বাংলাদেশে। আমি বিশ্বাস করিনি; বিশ্বাস করলেই তো আমাকে আরো খোঁজাখুঁজি করতে হবে! অনেক সময় অবিশ্বাসীর দায় কমে যায়।

আঙ্গুরবালা, তুমি নিশ্চয়ই কলমিশাকও খেতে ভালোবাসো? এইতো সেদিন, ডিসেম্বরের আট তারিখে (দু’ হাজার সতেরো) Sajjad Hossain Tuhin ও আমি হাঁটতে হাঁটতে গেলাম শহর ছাড়িয়ে পশ্চিমে রাজবাঁধের দিকে। ইতিউতি তাকাতেই দেখি একটা বিবর্ণ কলমিফুল আমাদের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ হাসি দেয়ার চেষ্টা করছে। গলদাঘেরের ভেড়ি (dike) থেকে কাণ্ডটা বাড়িয়ে গুটিগুটি হাঁটছে জলের পানে। কিন্তু জলে যে হারে রাসায়নিক দেয়া তাতে বোধহয় টিকতে না পেরে ভেড়ির গা ঘেঁষে এদিক ওদিক চলতে চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে লাউ, মিষ্টি কুমড়ো, ঢেঁড়শ, ইপিল ইপিল, ধঞ্চে, মুথাঘাস, ঘোড়াগুলঞ্চ - ইত্যকার দৈনন্দিন কাঙ্ক্ষিত-নিন্দিতরা সব জায়গা ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছেন। সেই যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন না, “অন্যের পকেট হইতে টাকা হাতাইয়া নিজ পকেটে নেয়ার নামই উপার্জন করা; কেননা তুমি জন্মাইবার পূর্বেই পৃথিবীর সমস্ত টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হইয়া গিয়াছে।” তেমনি উদ্ভিদজগতেও ‘তুমি জন্মাইবার পূর্বেই পৃথিবীর সমস্ত ঊর্বর জমি ভাগ-বাটোয়ারা হইয়া গিয়াছে।’ এ কলমিটাও তেমনি কার না কার জায়গা দখল করে নিজের খানিকটা ঘর-সংসার পাতিয়ে বসছিলো।

Convolvulaceae গোত্রের কয়েকজন সদস্য খাঁড়া বা আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেও এ ভদ্রলোক তা পারেন না। পারবেই বা কী করে? কার্ল লিনিয়াস যে তাঁর নাম দিয়েছেন Ipomoea, সে কি আর এমনি এমনি? ল্যাটিন শব্দ ইপোমিয়া শব্দের অর্থ হলো যে আশ্রয়কে পেঁচিয়ে এগোয়। আর অ্যাকুয়াটিকা শব্দটার অর্থ তো তুমি জানো, জলজ। জলাভূমিতে কাউকে জড়িয়ে ধরে যে বেড়ে চলে তার নাম কলমি। তবে সে স্থলেও চলতে পারে, তবে অবশ্যই জলের ধারে। এই ধাবকলতার (stolon) অগ্রভাগ কোমল যা আমরা কেটে খেতে পছন্দ করি। পাতার কথা কী বলবো? অন্য উদ্ভিদের পাতা বোঝাতে কলমিপাতার সাথে তুলনা করা হয়। এজন্য একটা আলাদা শব্দও আবিস্কৃত হয়েছে : Hastate (কলম্ব পত্রাকার)।

যাকগে, ভারি ভারি কথা না বলে এসো, আরেকটা গল্প করি।

কার্ল লিনিয়াসের বয়স তখন ২৫ বছর। সুইডেনের হেলসিংকিতে একটা ছেলে জন্মালো ১৭৩২ সালের ১১ জানুয়ারি। হেলসিংকি আবার সুইডেনে হয় কী করে? এ তো ফিনল্যান্ডের রাজধানী! তখন ফিনল্যান্ড সুইডেনের অধীনে ছিলো। ১২৯০ সালে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের নামে ফিনল্যান্ডের আদিবাসীদের খ্রিষ্টীয় করা হয় এবং ১৮০৯ সালের রাশিয়া-ফ্রান্স-ফিনল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে সুইডেন হেরে যাবার পূর্ব পর্যন্ত এই দাসত্ব বহাল থাকে।

বাবার ফর্সকাল বংশ অনুযায়ী সুশ্রী সুদর্শন ছেলেটির নাম রাখা হলো Peter Forsskål (পিটার ফর্সকাল)। অল্প বয়সেই বাবার পেশার সূত্রে সুইডেনের শিক্ষাশহর উপসালায় যাবার সুযোগ পেয়ে যান। মাত্র দশ বছর বয়সে ১৭৪২ সালে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Uppsala University) ভর্তি হন যেখানে পড়াতেন শ্রেণিকরণতত্ত্বের জনক কার্ল লিনিয়াস (Carl Linnaeus)। বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। ফলে সব ছেড়েছুঁড়ে বাড়ি ফিরে যান এবং নিজের মতো করে পড়াশোনা শুরু করেন। এখানেই তাঁর প্রকৃতিবিদ্যা রপ্ত করা হয়ে যায়।

অবশেষে ১৯ বছর বয়সে ১৭৫১ সালে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হন। এই সময়ই কার্ল লিনিয়াস ও প্রাণকণিকাবিদ কার্ল অরিভিলিয়াসকে (Carl Aurivillius) শিক্ষক হিশেবে পেয়ে যান। দু’জনেই এই মেধাবী ছাত্রটিকে অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। অরিভিলিয়াসের বন্ধু ছিলেন তৎকালীন হিব্রু, আরবি ও ফার্সি ভাষাবিদ, প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ জোয়ান ডেভিড মিকাইলিস (Johann David Michaelis)। তিনি পড়াতেন জার্মানির গোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সুতরাং অরিভিলিয়াস ১৭৫৩ সালে পিটারকে প্রাচ্যবিদ্যা পড়তে পাঠিয়ে দেন গোটিনজেনে। তখনকার দিনে প্রাচ্যবিদ্যা বলতে বোঝাতো আরববিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান। এছাড়া চীনতত্ত্ব ও ভারততত্ত্ব আলাদাভাবে পড়ানো হতো। কয়েকশ’ বছর ধরে তুরস্ক ও মিশরসহ আরব উপদ্বীপ ছিলো ইউরোপীয়দের বেহেশতি মেওয়া কারণ স্থলপথে ভারতে প্রবেশ করতে হলে আরব ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। প্রাচ্যবিদ্যা রপ্ত করে পিটার প্রথম প্রয়োগ করেন নিজের নামের ওপর। Peter Forsskål পাল্টে হয়ে যান Pehr Forsskåhl। এরপরে তিনি আরো কয়েকবার তাঁর নামের বানান পাল্টেছেন। তবে এখন তাঁকে আদিনামেই ডাকা হয়।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে প্রাচ্যের ভাষা, দর্শনে ঝানু হয়ে ‘আধুনিক দর্শনের মূলনীতির সমস্যাবলী’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ লিখে ডক্টরেট ডিগ্রিও পেয়ে যান। এরপর উপসালায় ফিরে আসেন তিনি; তখন ১৭৫৬ সাল। অর্থনীতিতে পড়াশোনা শুরু করেন ফর্সকাল। ১৭৫৯ সালে নভেম্বরে ‘সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ বিষয়ে একটি প্রচারপত্র লেখেন যার জন্য সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে। স্বাধীন প্রচারমাধ্যম সম্পর্কে এটি পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান রচনা। সরকার তাঁর প্রচারপত্রটি নিষিদ্ধ করে দেয় এবং নির্বাসনের দণ্ড দেয়। জেদি ফর্সকাল তাতেও থামেননি। একই প্রচারপত্রের কয়েকটি সংখ্যা বের করেন। ফলে সুইডেনে বাস করা তাঁর জন্যে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

মাঠে নামেন লিনিয়াস। ইতোমধ্যে লিনিয়াস তাঁর নতুন তত্ত্বের কারণে পুরো ইউরোপে সম্মানলাভ করছেন। বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানীরা তাঁর অনুসারীতে পরিণত হয়েছেন এবং বিপুলসংখ্যক ছাত্র ‘লিনিয়াসের শিষ্য’ (Apostle of Carl Linnaeus) হবার জন্য উপসালায় এসে হাজির হয়েছে। এই শিষ্যদের নিয়ে লিনিয়াস একটা নতুন কর্মসূচি চালু করেছেন। সুইডিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায় এক একজন ছাত্রকে তিনি পৃথিবীর এক এক কোণে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ছাত্ররা সেখান থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করে, ছবি এঁকে, নোট লিখে লিনিয়াসকে পাঠান, আর লিনিয়াস সেইসব দেখে নতুন নতুন উদ্ভিদ শনাক্ত করেন।

ইতোমধ্যে শিষ্যদের অভিযানে পাঠানোকে কেন্দ্র করে লিনিয়াস রাজার অপ্রিয়ভাজন হয়ে যান। ফলে তাঁর কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাবার সম্ভাবনা লিনিয়াসের ছিলো না। কিন্তু শিষ্যকে বাঁচানো আর নমুনা সংগ্রহ দুটো বিষয় একসাথে মেলাতেই হবে যে! এগিয়ে আসেন মিকাইলিস। তিনি ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিককে রাজি করিয়ে ফর্সকালকে জার্মান প্রাচ্যবিদ ও গণিতবিদ কার্সটেন নিয়েবুরের (Carsten Niebuhr) সঙ্গে আরব অভিযানে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। ঘাড়বাঁকা ফর্সকালও এই অভিযানে যাবার জন্য মেতে ওঠেন।

২৭ বছরের তরুণকে লিনিয়াস মিশর, ইয়েমেন ও দক্ষিণ আরবের উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকও বলে দেন যে, ইউরোপের খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা, বিশেষত লিনিয়াস, পরীক্ষা না করা পর্যন্ত কোনো নমুনা ডেনমার্কে পাঠানোর দরকার নেই। প্রায় দুই বছর ডেনমার্কে নির্বাসন কাটাতে হয় ফর্সকালের। এই সময় তিনি ইউরোপের বাঘা বাঘা উদ্ভিদ ও প্রাণীবিদের কাছ থেকে শ্রেণিকরণবিদ্যা শেখেন। ১৭৬১ সালে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছেই অনেকগুলো নমুনা সংগ্রহ করেন। কিন্তু ভাষা না জানায় দুর্গম অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ কারণে এক বছর মিশরে থেকে যান এবং আরবি সঠিক উচ্চারণ শিখে নেন যাতে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে সাহায্য পান।

১৭৬২ সালের ডিসেম্বরে ফর্সকাল ইয়েমেন পৌঁছান এবং দুর্গম অঞ্চলগুলোতে গিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন। এখানে তিনি গুগলা বা গুগ্গল (Commiphora) উদ্ভিদটি খুঁজে পান। লিনিয়াস বিশেষভাবে এ উদ্ভিদটি সংগ্রহের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এরই ভেতর ফর্সকাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায়ও গুরুর আদেশ পালন গেছেন তিনি। দুই সপ্তাহ রোগে ভুগে আত্মীয়-পরিজন থেকে বহুদূরে এক জঙ্গলের কিনারায় অসহায়ভাবে মারা যান পিটার ফর্সকাল নামের এক জেদি, একরোখা উদ্ভিদবিদ। তারিখটি ১১ জুলাই ১৭৬৩, বয়স মাত্র ৩১ বছর।

তার মৃত্যুর পর অভিযাত্রী-দলের সদস্য নিয়েবুর “মিশর ও আরবের উদ্ভিদ ও প্রাণী” নামে বইটি ফর্সকালের নামেই প্রকাশ করেন। কার্ল লিনিয়াস প্রিয় শিষ্যের মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। ফর্সকালের পাঠানো একটি উদ্ভিদের নাম রাখেন Forsskaolea tenacissima কারণ উদ্ভিদটি একরোখা, খাঁড়া হয়ে থাকে এবং উষর মরুতেও জন্মাতে পারে যা ফর্সকালেরই চরিত্রের বহিপ্রকাশ। ফর্সকালের শনাক্ত করা উদ্ভিদগুলোর বৈজ্ঞানিক নামের শেষে Forssk. লেখা হয়।

এসো ফিরে যাই আবার কলমিতে : কিছু বছর আগে ব্যাংককে এক রেস্তোঁরায় রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম। ওরা এক গামলা সব্জি দিলো। নাম বললো, মর্নিং গ্লোরি। একদমই বুঝতে পারিনি কোন সব্জির কথা বলছে। খাবার সময় চেনা চেনা লাগছিলো। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, কলমি না তো? গুগল মামাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম কলমিশাকই মর্নিং গ্লোরি। তারপরে দুঃখ হতে শুরু করলো, ইউরোপীয়দের পাল্লায় পড়ে গুচ্ছের টাকা খরচ করে শেষে কলমিশাক খেলাম! 

 বাঙলা নাম : কলমি, কলমিলতা, কলমিশাক, সাদই মোরক (মার্মা)
সংস্কৃত নাম : কলম্ব, কলম্বিকা, কলম্বী, নালিকা
বৈজ্ঞানিক নাম : Ipomoea aquatica Forssk. (1775)
সমনাম : Ipomoea natans Dinter & Suess.; Ipomoea repens Roth; Ipomoea reptans Poir.; Ipomoea sagittifolia Hochr.; Ipomoea subdentata Miq.
দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য নাম : কলমৌ (অসমীয়), কলমি সাগ (হিন্দি), নালি (হিন্দি), কোলম্নি (মণিপুরী), নলিচি ভাজি (মারাঠি), কলমা সাক (উড়িয়া), সরকরাইবল্লি (তামিল), তুতিকুড়া (তেলেগু),
ইংরেজি নাম : Water Morning Glory, Swamp Cabbage, Swamp Morning-glory, Aquatic Morning Glory, Chinese Water Spinach

বৈজ্ঞানিক নামের শেষে নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছো, লেখা আছে একজনের নাম? কার নাম বলো তো?

এখন আমি নিশ্চিত, প্রতিবার কলমিশাক খাবার সময় তোমার একটা নাম মনে পড়বে - পিটার ফর্সকাল, এক হতভাগ্য ঘাড়ত্যাড়া উদ্ভিদবিদ!